রবিবার, ৬ জুন, ২০১০

পঞ্চগড় জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য

আধুনিক পঞ্চগড় জনপদটি আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও এর প্রাচীন ও প্রাগৈতিহাসিক ইতিবৃত্ত অত্যন্ত সম্বদ্ধ। অতি প্রাচীন ও প্রাগৈতিহাসিক ইতিবৃত্ত সম্বদ্ধ করেছে হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের সর্বোত্তরের এই জনপদটিকে। পঞ্চগড় জেলার নামই এর যথার্থ স্বাক্ষ্য বহন করে। হিন্দু ও বৌদ্ধ যুগে পুন্ড্র বর্ধন নগরীর অনতিদূরেই ছিল আজকের পঞ্চগড়ের অবস্থান। ভিন্নমতে, গৌড় রাজ্যকে এক সময় বলা হতো পঞ্চগৌড়। আর পঞ্চগৌড় হতেই প্রাকৃত ভাষার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী না-কি পঞ্চগড়ের নামকরণ। অবশ্য বহুল প্রচলিত মত হলো- ভিতরগড়, মিরগড়, হোসেনগড়, রাজনগড় ও দেবেনগড়- এই পাঁচটি গড় অর্থাৎ মাটির তৈরী দূর্গ এর নামানুসারেই পঞ্চগড় নামটির উৎপত্তি। পঞ্চগড় জেলার বর্তমান ভূ-খন্ড প্রাচীনকাল থেকেই যথাক্রমে প্রাগজ্যোতিষ, কামরূপ, কামতা, গৌড়, কুচবিহার, দিল্লীর সাম্রাজ্য ও বৃটিশদের শাসনাধীনে ছিল। বৃটিশ শাসনামলে পঞ্চগড় জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ১৯১১-১৯১২ খ্রিস্টাব্দেই একটি পূর্ণাংগ থানায় উন্নীত হয়। ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির সময় বর্তমান পঞ্চগড় জেলার ৪টি থানা জলপাইগুড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিনাজপুর জেলার অন্তর্ভূক্ত করা হয। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৯সালে এখানে স্থাপিত হয় মুন্সেফ, ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট, পুলিশ ইন্সপেক্টর ও সার্কেল অফিস। অতঃপর ঠাকুরগাঁও মহকুমার আটোয়ারী থানাকে বোদা, দেবীগঞ্জ, পঞ্চগড় ও তেঁতুলিয়ার সাথে যুক্ত করে পঞ্চগড় মহকুমা গঠিত হয় ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারী। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারী পঞ্চগড় জেলায় উন্নীত হয়। ১৯৮৪ সালে জেলা হবার পর ১৯৮৫ সালে পঞ্চগড় সালে পঞ্চগড় পৌরসভার স্বীকৃতি পায়। ১৭৬৩-১৮০০ সালৈ বৃটিশবিরোধী সন্ন্যাসী আন্দোলন, ফকির বিদ্রোহ এখানেই বিস্তার লাভ করে। এ জেলা থেকেই ১৯৪৬ সালে তেভাগা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে এ অঞ্চলের জনগণের বীরোচিত ভূমিকা তেঁতুলিয়াকে মুক্তাঞ্চলে পরিণত করে। পঞ্চগড়ের লোক সংস্কৃতিতেও রয়েছে এক নিজস্ব অনন্য বৈশিষ্ট্য। প্রাচীনকাল হতে আজ অবধি সমভাবেই আদৃত হয়ে আসছে এখানকার "ধোকড়া শিল্প"। উত্তরবঙ্গীয় উপভাষার অন্তর্গত হলেও পালি, প্রাকৃত, প্রাচীন ও মধ্যবাংলা এবং ব্রজবুলি-আসামী-হিন্দী-বিহারী ইত্যাদি শব্দগুচ্ছের উপস্থিতি পঞ্চগড়ের আঞ্চলিক ভাষায় এনে দিয়েছে ব্যাপক স্বাতন্ত্র্য। সীমান্ত পরিবেষ্টিত এ জেলায় বিস্তর নৃ-তাত্ত্বিক বৈচিত্র পরিলক্ষিত হয়। মুসলিম ও হিন্দু প্রধান জনধারা ছাড়াও রাজবংশী, কোচ, পলিঢা, সাঁওতাল, ওঁরাও, হাড়ি, বেহারা প্রভৃতি আদিবাসীর মিশ্র রূপায়ন দৃঢ় করেছে পঞ্চগড়ের নৃ-তাত্ত্বিক ভিত্তিকে। করতোয়া , মহানন্দা, চাওয়াই, ভেরসা, তালমা, পাথরাজ, ডাহুক বিধৌত এই পঞ্চগড়েই জন্মেছেন ডাঃ সলিমুল্লাহ, গমির উদ্দীন প্রধান, মির্জা গোলাম হাফিজ, এ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম, কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ, এ্যাডভোকেট আযুবউল হক, ব্যারিষ্টার মুহাম্মদ জমিরউদ্দীন সরকার, মোঃ মোজাহার হোসেন, নাজিমুল ইসলাম ও মোবারক আলীর মতো ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব। বর্তমানে পঞ্চগড় জেলা ৫টি উপজেলা, ২টি পৌরসভা, ৪৩টি ইউনিয়ন এবং ৮৬২টি গ্রাম নিয়ে গঠিত। জেলায় ১২টি ছিটমহল রয়েছে। উপজেলাগুলো হচ্ছে- পঞ্চগড় সদর, বোদা, আটোয়ারী, দেবীগঞ্জ ও তেঁতুলিয়া। পৌরসভা ২টি হচ্ছে- পঞ্চগড় পৌরসভা ও বোদা পৌরসভা। ২০০৪ সালে বাংলাবান্ধায় স্থাপিত একটি পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর নিঃসন্দেহে জেলার গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে। ভূ-গর্ভস্থ হতে উত্তোলিত পাথর, মোটা বালি ও অতি সম্প্রতি পঞ্চগড়ের চা-শিল্প, কমলা চাষ, পোল্ট্টি ফার্ম এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে যোগ করেছে এক ভিন্নমাত্রা। পঞ্চগড় জেলার দর্শনীয় স্থান সমুহের মধ্যে রয়েছে- ভিতরগড়, বদেশ্বরী গড়, বদেশ্বরী মন্দির, মির্জাপুর শাহী মসজিদ, ছেপড়াঝাড় পাহাড়ভাঙ্গা মসজিদ, শালডাঙ্গা গোলকধাম মন্দির, বার আউলিয়ার মাজার, তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো, পঞ্চগড় মহিলা কলেজ রকস্ মিউজিয়াম, বাংলাবান্ধ স্থল বন্দর, তেঁতুলিয়া জিরো পয়েন্ট। [ তথ্যসূত্রঃ (১) জেলা উন্নয়ন পরিক্রমা (২০০১-২০০৫) পঞ্চগড়, গণযোগাযোগ অধিদপ্তর, তথ্য মন্ত্রণালয়। (২) সচিত্র বাংলাদেশ, মার্চ ২০০৮খ্রিস্টাব্দ, ফাল্গুন-চৈত্রঃ১৪১৪। (৩) পঞ্চগড় জেলার ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি, নাজমুল হক, বাংলা একাডেমি, ঢাকা। ]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন