সোমবার, ৭ জুন, ২০১০

পঞ্চগড়ের রাষ্ট্রীয় সীমানা

২৬ ডিগ্রি ২০মিনিট উত্তর অক্ষাংশে এবং ৮৮ ডিগ্রি ৩৪ মিনিট পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত পঞ্চগড় "জেলা" হিসেবে নবগঠিত ও আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও এর পারিপার্শ্বিক ভৌগলিক অবস্থান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৪৭ সালে স্যার সিরিল রেডক্লিফ কর্তৃক নির্দেশিত এই জেলার সীমান্ত রেখা অত্যন্ত আঁকাবাঁকা ও ভঙ্গুর। পঞ্চগড় জেলার তিনদিকেই ভারতীয় সীমান্ত। এই সীমান্ত অঞ্চল ১৮০মাইল বা ২৮৮ কিলোমিটার। জেলার মোট আয়তন ৫৯৩.২৪ বর্গমাইল। এ জেলার উত্তরে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা, উত্তরপূর্ব ও পূর্বে জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলা এবং বাংলাদেশের নীলফামারী জেলা, পশ্চিমে ভারতের পূর্ণিয়া ও উত্তর দিনাজপুর এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্বে ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলা অবস্থিত। রেডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার ৩০টি থানার মধ্যে ০৯টি সম্পূর্ণ এবং ০১টি আংশিকভাবে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। অবশিষ্ট ২০টি থানার মধ্যে পোরসা, পত্নীতলা ও ধামইরহাট থানাকে রাজশাহী জেলার অন্তর্ভূক্ত করা হয়। একই সময় জলপাইগুড়ি জেলার দেবীগঞ্জ, বোদা, তেঁতুলিয়া ও পঞ্চগড় থানাকে কেটে যুক্ত করা হয় দিনাজপুর জেলার সঙ্গে। স্যার রেডক্লিফ ১৯৪৭ সালে দিনাজপুর জেলার অংশ হিসেবে পঞ্চগড় অঞ্চলের যে সীমানা নির্দেশ করেন তা হলো- A line shall be drawn along the boundary between the thana of "Phansidewa" in the dristrict of Derjeeling and the thana "Tetulia" in the district of "Jalpaiguri" from the point where the boundary meets the provinence of Bihar and then along the boundary between the thana of 'Tetulia' and 'Rajgamg' : The thanas of "Panchagarh" and "Rajgang" : and the thana of "Panchagarh" and "Jalpaiguri"; and shall then continue along the northern corner of the thana "Debigang", to the boundary of the state of "Cooch-Bihar". The district of 'Darjeeling' and so much of the district of 'Jalpaiguri' as lines north of this line shall belong to west Bengal. (বিহার প্রদেশের সীমানা যেস্থানে দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলার সীমানাকে স্পর্শ করেছে, সেখান থেকে একটি রেখা দার্জিলিং জেলার "ফাঁসিদেওয়া" থানা এবং জলপাইগুড়ি জেলার তেঁতুলিয়া থানার মধ্য দিয়া টানা যেতে পারে। এরপর রেখাটি তেঁতুলিয়া ও রাজগঞ্জ থানার মধ্যদিয়ে এবং পঞ্চগড় ও রাজগঞ্জ থানা, অতঃপর পঞ্চগড় এবং জলপাইগুড়ি থানার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে, দেবীগঞ্জ থানার উত্তর কোণকে স্পর্শ করে কোচবিহার রাজ্যের সীমানা পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা যেতে পারে। দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা দুটি এই রেখার উত্তর প্রান্তে অবস্থান করতে এবং তা হবে ভারতীয় ভূ-খন্ডের অন্তর্ভূক্ত।) রেডক্লিফ মিশন কর্তৃক পঞ্চগড় থানার সীমানা নির্দেশ করতে গিয়ে জলপাইগুড়ি জেলার ১২নং বেরুবাড়ি ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় জটিলতা। সে সময় সমস্ত ইউনিয়নকে তৎকালীন পাকিস্তানভূক্তির দাবী উঠেছিল। কিন্তু কার্যত তা বাস্তবায়িত হয়নি। এই অমীমাংসিত বিষয়টি দু'দুবার রাষ্ট্রীয় শীর্ষ পর্যায়ে চুক্তি দ্বারা নির্দেশিত হয়। প্রথমত ,"নেহেরু-নুন" চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।দ্বিতীয়ত, "মুজিব-ইন্দিরা" চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৬ মে ১৯৭৪ সালে।


নেহেরু-নুন চুক্তি- ১৯৫৮


This will be so divided as to give half of the area of Pakistan the other half adjacent to India being retained by India. The division of Berubari-12 will be horizontal, starting from the north-east corner of Debigang thana. The dividsion should be made in such a manner that the Kooch-Bihar enclaves between Panchagarh thana of East Pakistan and Berubarie Union No-12 of Jolpaiguri thana of west Bengal will remain connected as at Present with Indian territory and will remain with India. The "Kooch- Bihar" enclaves lower down between Boda thana and Berubari Union-12 will be exchanged along with the general exchange of enclaves and will go to Pakistan.


মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি-১৯৭৪


India will retain the southern half of south Berubari Union-12 and the adjacent enclaves, measuring an area of 2.64 square miles approximately, and in exchange Bangladesh will retain the "Dahagram" and "Angorpota" enclaves. India will lease in Perpetity to Bangladesh an area of 178m. X 85m. near "Tin Bigha" to connect "Dahagram with "Panbari" mouza (PS. Patgram) of Bangladesh.
"নেহেরু-নুন" চুক্তিতে বেরুবাড়ী ১২নং ইউনিয়ন পূ্র্ববৎ থাকার কথা উল্লেখ রয়েছ। পক্ষান্তরে, ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাঢ়ী ইউনিয়নের অর্ধাংশের পরিবর্তে বাংলাদেশকে "দহগ্রাম" ও "আঙ্গুরপোতা" ছিটমহল প্রদানের কথা বলা হয়েছে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাক-ভারত বিভক্তির সময় বর্তমান পঞ্চগড় জেলার ৪টি থানা তৎকালীন জলপাইগুড়ি জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে তৎকালীন দিনাজপুর জেলার সঙ্গে জুড়ে দেয়ার ফলে যথেষ্ট হেরফের হয়েছে রাষ্ট্রীয় সীমানার।
থানা সাল আয়তন ১৯৬১ সালে আয়তন ১৯৯০ সালে আয়তন
বোদা ১৮৭২ ৪৭৫ বর্গমাইল ১৬৬ বর্গমাইল ১৪০ বর্গমাইল
পঞ্চগড় ১৯২১ ৯৬ বর্গমাইল ১০৩ বর্গমাইল ১২০ বর্গমাইল
দেবীগঞ্জ ১৯২১ ১১১ বর্গমাইল ১১৯ বর্গমাইল ১১৯ বর্গমাইল
তেঁতুলিয়া রাজগঞ্জ ১৯০১ ৩২৪ বর্গমাইল ৭৪ বর্গমাইল ৭৪ বর্গমাইল
আটোয়ারী ------ --------- ৮১ বর্গমাইল ৮১ বর্গমাইল
উল্লেখিত পরিসংখ্যান নির্দেশ করে যে, বোদা ও তেঁতুলিয়া থানার আয়তন ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। পঞ্চগড় ও দেবীগঞ্জ থানার আয়তন ছিল মোটামুটি স্থিতিশীল। ১৯৬১ সালের পর পুনরায় বোদা ও পঞ্চগড় থানার আয়তন ও সীমানার উল্লেখযোগ্য রূপান্তর পরিলক্ষিত হয়।
পঞ্চগড় জনপদের ভৌগলিক ও রাষ্ট্রীয় পরিচয় সম্পর্কে বিভিন্ন পুরাণ গ্রন্থে অভাস ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এই ভূ-খন্ড প্রাচীনকালে প্রাগজ্যেতিষ, কামরূপ, রত্নপীঠ, সৌমারপীঠ, পুন্ডবর্ধন এবং মধ্যযুগে কোচবিহার রাজ্যের অবিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে বিদ্যমান ছিল। প্রাগৈতিহাসিক কালে পঞ্চগড়সহ কামরূপ রাজ্যের আয়তন ও সীমানা সম্পর্কে "কালিকা পুরাণে" , "কামাখ্যাতন্ত্রে" ও "যোগিনীতন্ত্রে" বিবরণ পাওয়া যায়। কালিকা পুরাণে লিপিবদ্ধ রয়েছে- নারায়ণ পূর্বদিকে ললিতকান্তার এবং পশ্চিমে পঞ্চগড় জনপদের মধ্যে প্রবাহিত "করতোয়া" নদীর মধ্যবর্তী ভূ-খন্ড রাজা নরককে প্রদান করেছিলেন। এটিই প্রাচীন কামরূপ রাজ্য। তার পূর্বে ঐ অঞ্চলে কর্কমকায় "কিরাত" জাতি বসবাস করতো। নেপালের "তরাই" অঞ্চলে (তেঁতুলিয়া থানার কিয়দংশ) বসবাস করতো অনেক "কিরাত" আদিবাসী। পঞ্চগড় জনপদের "কীচক" জনগোষ্ঠী সম্ভবত কিরাত জাতির উত্তর পুরুষ। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমী তাঁর ভূ-বৃত্তান্তমূলক গ্রন্থে "কিরাদিয়া" জাতির উল্লেখ করেছেন। বিশেজ্ঞগণ "কিরাদিয়া"-কে "কিরাত" জাতি বলে মনে করেন এবং এদেশের বাসস্থান হিসেবে নির্দেশ করেন পঞ্চগড় জনপদসহ "কামরূপ রাজ্যকে"।
"যোগিনীতন্ত্রে" কামরূপ রাজ্যের সীমা নির্দেশ করা হয়েছে এভাবে- এই রাজ্য "করতোয়া" নদী থেকে দিবকরবাসিনী পর্যন্ত প্রসারিত; এদেশের উত্তরে 'কঞ্জগিরি'- পশ্চিমে পঞ্চগড়ের করতোয়া নদী, পূর্বদিকে দিক্ষ নদী, দক্ষিণে বৃহ্মপুত্র (লৌহিত্য) এবং লাক্ষা নদীর মিলনস্থল অবস্থিত।-এই ভূ-খন্ডটি ত্রিভূজাকৃতি। দৈর্ঘ্যে শত যোজন অর্থাৎ আটশত মাইল এবং প্রস্থে ত্রিশ যোজন অর্থাৎ দুইশত চল্লিশ মাইল। এই সীমারেখা প্রমাণিত করে যে, বর্তমান ভূটান রাজ্যের কিছু অংশ এবং রংপুর, কোচবিহার ও পঞ্চগড় ছিল কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভক্ত।
গুণাভিরাম বড়ুয়া সংকলিত "আসাম বুরুঞ্জী" (১৯৮৪) গ্রন্থেও বলা হয়েছে যে, ব্রহ্মপুত্র নদের তীরভূমি, রংপুর, কোচবিহার এবং জলপাইগুড়ি(পঞ্চগড়) সম্পূর্ণরূপে ছিলো কামরূপ রাজ্যের অধীন। সমগ্র উত্তরবঙ্গ প্রাচীনকালে "পুন্ডবর্ধন" নামে পরিচিত ছিল। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে "পুন্ডবর্ধন" গুপ্ত রাষ্ট্রের একটি সমৃদ্ধশালী ভুক্ততে পরিনত হয়। পঞ্চম শতকের দামোদরপুর লিপি অনুযায়ী জানা যায় যে, পুন্ডবর্ধন এক সময় বিস্তৃত ছিল হিমালয় শিখর থেকে সমুদ্র পর্যন্ত। বিহার রাজ্যের কুশী বা কৌশিক নদী এবং করতোয়া নদীর মধ্যবর্তী ভূ-ভাগই ছিল প্রাচীন পুন্ড্রজনপদ। সুতরাং পঞ্চগড় জনপদ যে পুন্ড্রবর্ধন ভূক্তির আয়তনভূক্ত ছিল, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
নবম শতাব্দীর রাজা বনমালের তাম্রশাসনে "ত্রিস্রোতা" নদীর (চিলাহাটী, দেবীগঞ্জ অঞ্চলের বুড়াতিস্তা) পশ্চিমে ভূমি দান করার কথা উল্লেখ রয়েছে। স্থানটি নিঃসন্দেহে পঞ্চগড় জনপদে অবস্থিত। চতুর্দশ শতাব্দীর গৌড়েশ্বর সেকান্দার শাহের মুদ্রায় "কামরূপ" ওরফে চাউলিস্তান" মুদ্রিত রয়েছে। পঞ্চগড় জনপদে "চাউলিয়া", "চাউলহাটি" বহুল ব্যবহৃত ও প্রচলিত শব্দ। পঞ্চদশ শতাব্দীর হোসেনশাহী মুদ্রায় "কামরূপ" ও "কামতা"-দুটি দেশের নাম লেখা রয়েছে। সুলতান হোসেন শাহ পূর্ণিয়া থেকে এসে পঞ্চগড়ের উপর দিয়ে কামরূপ অভিযানে অগ্রসর হন এবং সেদেশ জয় করেন। "আইন-ই-আকবরী" ও "বাহরিস্তান-ই-গাইবী" গ্রন্থে "কোচ" দেশ এবং তার মধ্যে "কামতা" ও "কামরূপ" রাজ্যের নাম উল্লেখ রয়েছে। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রচিত শাজাহানামায়" কামরূপ রাজ্যের পশ্চিমার্ধের নাম "কামতার" পরিবর্তে :কোচবিহার" এবং পূর্বাঞ্চলের "কামরূপ" স্থলে 'কোচ' 'হাজো' উল্লেখিত হয়েছে। বস্তুত, আধুনিককালের রংপুর ও জলপাইগুড়ি (পঞ্চগড় সহ) অঞ্চলের কোচ অধিবাসী- যারা ঐতিহাসিককালে ছিল উত্তরবঙ্গ বিজেতা মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী সম্ভূত। তাদের নামে পশ্চিম কামরূপ দেশের নাম হয়েছে "কোচবিহার"। পঞ্চগড় জনপদ প্রায় ৪শত বছর ব্যাপী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ছিল কোচবিহার রাজ্যের শাসনাধীন।
বস্তুত, কামরূপ দেশ বিভক্ত ছিল চারভাগে- রত্নপীঠ, কামপীঠ, স্বর্ণপীঠ এবং সৌমারপীঠ। কালিকা পুরাণের মতে যে স্থানের নাম সৌমারপীঠ, ইতিহাসের মতে তারই নাম "কামতা" রাজ্য। পঞ্চদশ শতকের প্রথমভাগে খেন বংশীয় রাজা নীলধ্বজ স্থাপন করেছিলেন এই রাজ্য। নীলধ্বজ পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া থানাধীন দেবনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে ডঃ হেমিল্টন বুকানন উল্লেখ করেন। পঞ্চগড় জনপদ সুস্পষ্টভাবেই "রত্নপীঠ", সৌমারপীঠ বা "পশ্চিম কামরূপ" নামে পরিচিত ছিল। উইলিয়াম হান্টার এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন "করতোয়া" নদী রামায়ণ- মহাভারতের সময়কাল থেকে "বাংলা" এবং "কামরূপ" রাজ্যের সীমানা নির্দেশ করতো। সে হিসেবে বিভিন্ন সময় তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড় ও দেবীগঞ্জ থানার পূর্বাঞ্চল কামরূপ ও কোচবিহার রাজ্যের এবং করতোয়া নদীর পশ্চিমাঞ্চল "বাংলা" বা "গৌড়" রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল।
মুসলিম অধিকারের প্রথম দিকে গঙ্গা, করতোয়া ও মহানন্দা নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত ভূ-ভাগ নিয়ে খুব সম্ভব নবগঠিত তূর্কী-লখনৌতি রাজ্যের উপরিভাগ গঠিত ছিল (১২০৬খ্রিঃ)। বর্তমান পঞ্চগড়- আটোয়ারী পাকা সড়কের কাছাকাছি স্থানে করতোয়া নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী স্থান বরাবর ছিল লখনৌতি (গৌড়) রাজ্যের উত্তর সীমারেখা। পূর্বদিকে দেবীগঞ্জ থানার পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত এই সীমারেখা বিস্তৃত ছিল বলে অনুমান করা যায়। বখতিয়ার খলজির রাজ্য সীমা উত্তরে পঞ্চগড়ের উপর দিয়ে প্রবাহিত করতোয়া নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে ধরা যেতে পারে। করতোয়া নদীর উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ তেঁতুলিয়া থানার ভজনপুর অঞ্চল থেকে উপরের অংশ বাংলাবান্ধা পর্যন্ত পাল, সেন ও মুসলমান শাসনামলে গৌড়ের অন্তর্ভূক্ত ছিল। এ ভূ-খন্ড ছিল গৌড় রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চল।
মোঘল সুবাদার এবাদত খাঁ (১৬৮০ খ্রিঃ) দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘোটে ফৌজদার নিযুক্ত হওয়ার পর কোচ রাজ্যের বার বার আক্রমণ এবং অনুপ্রবেশ স্থায়ীভাবে প্রতিহত ও রুদ্ধ করার লক্ষ্যে সরকার ঘোড়াঘাটে নির্মাণ করেন অনেকগুলো সামরিক ঘাটি ও চৌকি। সেই সব সামরিক স্থাপনায় মোতায়েন করা হয় সার্বক্ষণিক সেনা সদস্য। শত্রু সেনার গতিবিধি লক্ষ্য রাখার জন্য সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমুহে নির্মাণ করা হয় "অবজারভেশন টাওয়ার" বা মাটির সুউচ্চ বুরুজ। কোথাএ কোথাও স্থাপন করা হয় কোচ ও মোঘল রাজ্যের সীমানা নির্দেশক সুদীর্ঘ, সুউচ্চ মাটির প্রাচীর। এগুলে জনসাধারণের নিকট "বান্দ" নামে পরিচিত। অর্থাৎ "বাঁধ 'বা আল।
করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরবর্তী গৌড় রাজ্য অর্থাৎ মোঘল, সাম্রাজ্যের একটি কৌণিক প্রত্যন্ত অঞ্চল তেঁতুলিয়া থানার "বাংলাবান্ধা" এ ধরণের একটি বিখ্যাত সীমান্ত প্রাচীর। এই গ্রামে পূর্ব-পশ্চিমে সম্প্রসারিত একটি দীর্ঘ মাটির প্রাচীর নির্মাণ করা হয় এবং বন্ধ করে দেওয়া হয় মোঘল শাসিত "বাংলা" ও "কোচ-কামতা" রাজ্যের মধ্যকার সীমান্ত। বলাবাহুল্য, বাংলাবান্ধার দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল ছিল "কোচ ও কামতা" রাজ্যের অধীন। পক্ষান্তরে, অদূরে প্রবাহিত করতোয়া নদীর পশ্চিমাঞ্চল (ভজনপুর, তেঁতুলিয়া ও আটোয়ারী) ছিল মোঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। কামতা ও কোচ রাজ্যকে (পঞ্চগড় জনপদের পূর্বাঞ্চল) বলা হতো বাংলার বহির্ভূত রাজ্য। মোঘলরা এ রাজ্য অধীকার করতে সক্ষম হলেও ক্ষমতার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য উভয় দেশের মধ্যে লেগে থাকতো যুদ্ধ, বিরোধ ও সংঘর্ষ।
সামগ্রিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, পঞ্চগড় জেলার বর্তমান ভূ-খন্ড প্রাচীনকাল থেকে যথাক্রমে প্রাগজ্যোতিষ, কামরূপ, কামতা, গৌড়, কোচবিহার, দিল্লীর সাম্রাজ্য এবং ব্রিটিশদের অধীনে শাসিত হয়। পাশাপাশি, এই জনপদের ভৌগলিক অবস্থান ছিল মগ্ধ, অযোধ্যা, বিহার, নেপাল, সিকিম, ভূটান, তিব্বত, আসাম ইত্যাদি রাজ্যের নিকটবর্তী। এটি ছিল সমকল সময় এবং সকল রাজ্যের সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত অঞ্চল। সে -কারণে পঞ্চগড় সামরিক দিক থেকে সব সময়ই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যসূত্র- নাজমুল হক, [পঞ্চগড় জেলার ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।]

1 টি মন্তব্য:

  1. পঞ্চগড় জেলার লোক সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে চাই। সংগৃহীত লেখাটি পোষ্ট করার জন্য ধন্যবাদ।
    জুই।

    উত্তরমুছুন