সোমবার, ৭ জুন, ২০১০

পঞ্চগড় জেলার জনগোষ্ঠীর নৃতাত্তিক বৈশিষ্ট্য

১৯৪৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত এবং বর্তমানে পূর্ণিয়া, পশ্চিম দিনাজপুর, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলা পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তবর্তী পঞ্চগড় জেলার জনগোষ্ঠীর নৃতাত্তিক বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের সামগ্রিক রূপের সঙ্গে অভিন্ন হলেও কোন কোন ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র বিদ্যমান। এ জেলার জনপ্রবাহের মধ্যে রয়েছ- হিন্দু ও মুসলিম প্রধান জনধারা, রাজবংশী, কোচ, পলিয়া, সাঁওতাল, ওঁরাও, হাড়ি, ভূইমাল, কামার-কুমার, বেহারা, কাহার, সুনরী প্রভৃতি। এই বিচিত্র জনধারার মিশ্র রূপায়ণেই গড়ে উঠেছে পঞ্চগড় জেলার নৃ-তাত্ত্বিক ভিত্তি। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী মোটামুটি দীর্ঘমুন্ড, প্রশস্ত নাসা, আদি অষ্ট্রেলীয়-দীর্ঘমুন্ড ও দীর্ঘ মধ্যোন্নতনাসা, মিশর-এশিয়া বা "মেলানিড"; এবং বিশেষভাবে গোলমুন্ড, উন্নতনাসা-"অ্যালপাইন-এই তিন নরগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। পঞ্চগড় জেলার জলধারাও "আদি-অষ্ট্রেলীয়", "অ্যালপাইন" ও "মঙ্গোলীয়" নরগোষ্ঠীর মিশ্র বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে। নৃতত্ত্ববিদগণ প্রায় সকলেই একমত যে, নিম্নবর্ণের বাঙ্গালী আদিবাসী উপজাতিদের মধ্যে "আদি-অষ্ট্রেলীয়" জনধারার প্রভাব সবচেয়ে বেশী। বস্তুত, আর্য ও দ্রাবিড় মানবগোষ্ঠী পশ্চিম দিক থেকে আগমন করলেও "আদি-অষ্ট্রেলীয়" জনগোষ্ঠী অষ্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে এসে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছিল মধ্য ও উত্তর ভারতে। এমনকি, এরা বসতি গড়ে তোলে দক্ষিণ ভারত ও সিংহল পর্যন্ত। সিংহলের "ভেদ্দা প্রতীম" আদিবাসী পূর্বসূরি বাঙ্গালীদের এরা সমজাতীয় বলে অনেকের ধারণা।
বলাবাহুল্য, পঞ্চগড় জেলার মানবধারার একটি বৃহৎ অংশ "আদি-অষ্ট্রেলীয়" জনধারার অন্তর্গত। এদের নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- দীর্ঘ শির, প্রশস্ত নাক, নাকের গোড়া অক্ষিকোটর থেকে খুব উঁচু নয়, কপাল কিছুটা ভেতরের দিকে চাপা, ভ্রুর হাড় কিঞ্চিত উঁচু। মুখের নিম্নভাগ সামান্য লম্বা ধরণের। ঠৌঁট যথেষ্ট মোটা, থুতনি কিছুটা কম উঁচু। মাথার চুল তরঙ্গায়িত ও কুণ্ডলাকৃত। চুলের রং গাঢ় বাদামি থেকে কাল, দাড়ি গোঁফ মোটামুটি হয় কিন্তু দেহে লোমের পরিমাণ কম। গায়ের রং বাদামি থেকে ঘোরতর কালো। দেহাকৃতি খাটো ও মাঝারি ধরনের। (৫ ফুট ২ ইঞ্চি)
পঞ্চগড় জেলার আদিবাসী-উপজাতি প্রতিম অর্থাৎ সাঁওতাল, ওঁরাও, হাড়ি, ভূঁইমালি, কামার, কুমার, বেহারা, কাহার, সুনরী প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর মানুষ মূলত "আদি-অষ্ট্রলীয়" নরগোষ্ঠীর অন্তর্গত। তবে এ জেলার নিম্নবর্ণের হিন্দু-মুসলমানের রক্তে এই জনধারার প্রভাব সবচেয়ে বেশী। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে উচ্চবংশীয় জনসাধারণের মধ্যেও এই নরগোষ্ঠীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। পামীর মালভূমি, তাকলামাকান মরুভূমি, আল।পস পর্বত (তুর্কী বাইরানীয়) দক্ষিণ আরব ও ইউরোপের পূর্বাঞ্চলবাসী গোলমুন্ড বিশিষ্ট একটি প্রবাহ বাংলাদেশের জনধারায় নিজেদের রক্ত প্রবাহ সঞ্চারিত করে। এই জনের সর্ব প্রাচীন সাক্ষ্য সংগৃহীত হয়েছে "হরপ্পা" ও "মোহেন-জো-দারো"-তে প্রাপ্ত কঙ্কাল থেকে। এই জনধারাকে নৃতত্ত্ববিদ লাপোং, রিজলী, লুসসান ও রামপ্রসাদ চন্দ "অ্যালপাইন" নরগোষ্ঠীরূপে আখ্যায়িত করেন। বাংলাদেশের উচ্চবর্ণের ও মধ্যম নাসাকৃতি এবং মধ্যম দেহ-দৈর্ঘ্যের লক্ষণ দেখা যায়- তা অনেকাংশে "অ্যালপাইন" নরগোষ্ঠীর দান। এই জনগোষ্ঠীর রক্তধারা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো পঞ্চগড় জেলার সম্ভ্রান্ত বংশীয় মুসলিম এবং হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মধ্যেও বিরাজমান। বস্তুত, বাংলাদেশের যে, নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও সংস্কৃতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছে, তার প্রায় সমগ্র মূল রূপায়ণই প্রধানতঃ "অ্যালপাইন" ও "আদি-অষ্ট্রেলীয়" এই দুই জনধারার লোকদেরই কীর্তি। পঞ্চগড় জেলা সম্পর্কে এই মন্তব্য প্রণীধানযোগ্য।
'বোডো' ভাষাগোষ্ঠী বা মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কোচ, রাজবংশী, পলিয়া ইত্যাদি জাতির একটি প্রধান ধারা পঞ্চগড় জেলায় পরিলক্ষিত হয়। এদের নৃবৈশিষ্ট্য হচ্ছে- নাক মধ্যমাকৃতি থেকে চ্যাপ্টা, মাথার আকৃতি সাধারণত গোল, অক্ষিপট সন্মুখীন, উন্নত গন্ডাস্থি, কেশবিহীন দেহ ও মুখমন্ডল, সোজা চুল, দাড়ি গোঁফ বিরল, গায়ের রং পীতাভ অথবা বাদামি পীতাভ এই জনগোষ্ঠী অতি প্রাচীনকালে দক্ষিণ-পশ্চিম চীন হতে ক্রমশ বৃহ্মদেশ, মালয় উপদ্বীপ এবং পূর্ব-দক্ষিণ সমুদ্র উপকূলীয় দেশ ও দ্বীপগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। পথে উত্তর আসাম এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় মিরি, নাগা, বোদো বা মেচ সম্প্রদায়ভূক্ত কোচ, পলিয়া, রাজবংশী প্রভৃতি লোকের মধ্যে একটি ধারা প্রবাহ ঐতিহাসিককালে বাংলাদেশে এসে ঢুকে পড়ে এবং রংপুর, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি প্রভৃতি অঞ্চলে এভাবেই খানিকটা মঙ্গোলীয় প্রভাব নিম্নস্তরের মানুষের রক্তে আত্মপ্রকাশ করেছে। পঞ্চগড় জেলার কোচ, পলিয়া, রাজবংশী জনগোষ্ঠী উল্লেখিত জনপ্রবাহের উত্তরষূরী। এছাড়াও পঞ্চগড় জেলায় আরো কিছু সংখ্যক ছোট ছোট সম্প্রদায় দীর্ঘকাল যাবৎ বসবাস করে আসছে। জলপাইগুড়ি জেলার- যার অন্যতম প্রধান ৪টি থানাই ছিল ১৯৪৭সাল পর্যন্ত পঞ্চগড় জেলার অবিভক্ত অংশ- ১৮৭২ সালে ডঃ উইলিয়াম হান্টার এর জাতিগত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ওঁরাও-৪৫৩ জন, বাগদী-১৪৬ জন, বেদিয়া- ১০৮ জন, চামার- ৪৩৬ জন, চন্ডাল- ১৯৮০ জন, ডোম-১৭৩, দোসাদ-৫৪ জন, হাড়ি-৪৫৫৫জন, কোচ-০৪জন, রাজবংশী-১,৩৭,১৩৫জন, মেথর-৩১১ জন, ভূঁইমালি-১৭৮, ব্রাহ্মণ-১২৭৫ জন, রাজপুত-৫২৩ জন, বৈদ্য-৮২ জন, কায়স্থ-৫৪৭ জন, আগরওয়ালা-৪৪ জন, গন্ধবণিক-৩৯৯ জন, সুবর্ণবণিক-৮১ জন, গোয়ালা- ৯৫০ জন, বারুই-৪০৬ জন, কৈবর্ত-২৯৭০ জন, সদগোপ-২৭৬ জন, বেহারা-১৪৭৮ জন, ধোবী-১৬৬ জন, হাজাম, নাপিত-২৫০৫ জন, কাহার-১৭৮ জন, কামার-৫১১ জন, কাঁসারী-৪১ জন, কুমার-৩২১৫ জন, স্বর্ণকার (সোনার)-৫৬ জন, সুনরী-১১১৬ জন, সূত্রধর-৭৩ জন, তেলি-২৭২৮ জন, যুগী-৮১৩ জন, তাঁতি-৪০৩৪ জন, জালিয়া-১৩৭০ জন, মাঝি-২২৭ জন, পাটনী-৩৫ জন, বয়াতি-২০ জন, বৈঞ্চব-১৮৭৭ জন, সন্ন্যাসী-১৮৯ জন, দেশীয় খ্রিস্টান-০৪ জন, জোলা-১৭, পাঠান-৫৬ জন, শেখ-০৪ জন।

১৯০১সালের জলপাইগুড়ি জেলা গেজেটিয়ারে উল্লেখিত ধর্মভিত্তিক ও উপজাতিভিত্তিক পরিসংখ্যান

থানা হিন্দু মুসলিম সর্বপ্রাণবাদ রাজবংশী ওঁরাও Nasya শেখ
রাজগঞ্জ ২৬,৯১৩ ২৪,৯৯২ ৭১ ২০,৩৬৫ ৩৯৭ ২১১০ ২২,৭৬২
তেঁতুলিয়া ৯০৭১ ১১৪৬৭ ------ ৫০৭০ ----- ৯৮৮১ ১৩৫৯
বোদা ৯১,৯২৪ ৭৩০৭৫ ------ ৭৬,৩৬৩ ২৫ ১১৮৭ ৭১,২১৩
১৯২১ সালে গৃহীত ধর্মভিত্তিক পরিসংখান

থানা হিন্দু মুসলিম সর্বপ্রাণবাদ খ্রিস্টান অন্যান্য
তেঁতুলিয়া ৭৯৪৫ ১১০৪৫ ১০ ০১ ০৩
বোদা ৪০১৪১ ৩৭২২২ ১১ ---- -------
পঞ্চগড় ১৪০৩৭ ১৮৭২৬ ১৩ ----- -------
দেবীগঞ্জ ৩৯৭৪২ ১৫২৯১ ৫০৪ ১০ ৯১

১৯২১ সালে গৃহীত আদিবাসী, উপজাতি পরিসংখ্যান

আদিবাসী/ উপজাতি তেঁতুলিয়া বোদা পঞ্চগড় দেবীগঞ্জ
রাজবংশী ৪৬৪৬ ৩১৪৫৯ ১১৯৩৮ ৩৪৩২৮
ওঁরাও ৩৯ ০৫ ০৯ ২৬৫
সাঁওতাল ০১ ৩০ ৫৭ ৫৯
মুন্ডা ০২ ০২ ০৭ ১০০
মেচ ------ ------ ------ ১৫
শেখ (মুসলিম) ১০৬৬৫ ৩৬৭০৭ ১৮৩৫৮ ১৪৯১০

১৯৩১ সালের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্ভূক্ত ৪টি থানার হিন্দু, উপজাতি ও আদিবাসীদের পরিসংখ্যান

হিন্দু/ আদিবাসী/ উপজাতি তেঁতুলিয়া বোদা পঞ্চগড় দেবীগঞ্জ
ব্রাহ্মণ ১৩৯ ২১১ ১১১ ১৫৪
কায়স্থ ৮৫ ৯৪১ ৪২ ৩৭৫
মুন্ডা ৫১ ----- ----- -----
ওঁরাও ১৬৯ ----- ---- ------
রাজবংশী ৬৯৮৫ ৩০০১৫ ১৩৩০৮ ৩৫২৬৯
সাঁওতাল ৬৭ ১৫২ ৫৮ ৫০৬

প্রায় ষাট বছর ব্যাপ্ত উল্লিখিত ধর্ম ও আদিবাসী-উপজাতি-গোত্রভিত্তিক পরিসংখান দ্বারা পঞ্চগড় জেলায় বসবাসরত বিভিন্ন নৃবৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সম্পর্কে একটি ধারণা অর্জন করা যায়। বস্তুত, উল্লিখিত জনপ্রবাহের সংমিশ্রণ ও সমন্বয়ের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে এ জেলার নৃতাত্ত্বিক ভিত্তি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। পঞ্চগড় জেলায় প্রাক-ঐতিহাসিক কাল থেকে এ পর্যন্ত সংমিশ্রণের ধারাটি মোটামুটি এ রকম-(ক) পাহাড়ী জাতি বা 'কিরাত' জনদের বসবাস। (খ) "আদি-অষ্ট্রেলীয়" নৃ-গোষ্ঠীর বসতি স্থাপন। (গ) "মঙ্গোলীয়" তথা "বোডো" গোষ্ঠীর জনদের আগমন। (ঘ) "অ্যালপাইন" নরগোষ্ঠী (পাল, সেন, তুর্কী, মোগল প্রভৃতি হিন্দু ও মুসলিম শাসক, সৈন্য, ধর্মপ্রচারক ও কর্মচারীর) আগমন ও বসতিস্থাপন। (ঙ) সিপাহী বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের পরাজিত বহিরাগত বিপ্লবীদের পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ, পঞ্চগড় ও তেঁতুলিয়া থানার গহীন অরণ্যে আত্মগোপন ও স্থায়ী বসবাস। (চ) ১৯৪৭ সালে ভারতের জলপাইগুড়ি থেকে এবং ১৯৫৩-৬৫ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের নোয়াখালি, ঢাকা, পাবনা ও ময়মনসিংহ জেলা থেকে লক্ষাধিক লোকের এ জেলায় আগমন ও বসতিস্থাপন।
পঞ্চগড় জেলার প্রাচীনতম জনগোষ্ঠী কারা, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য আমাদের হাতে নাই; পাওয়া সম্ভব নয়। তবে স্থানীয় অধিবাসীদের শারীরিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করে এ ধারণা সহজেই গ্রহণ করা চলে যে, তাদের পূর্ব-পুরুষগণের অনেকেই ছিলেন আদি-অষ্ট্রেলীয় নরগোষ্ঠীর অন্তর্গত। এই জনগোষ্ঠীর প্রভাব সম্প্রসারিত হয়েছে প্রধানত পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চল থেকে। তারও পূর্বে সম্ভবত "পাহাড়ী" ও "কিরাত" জাতি এ অঞ্চলে বসবাস করত বলে কালিকাপুরাণে উল্লেখ রয়েছে। এই দুই ধারণার পেছনে ঐতিহাসিক সত্য বিদ্যমান। বস্তুত, দক্ষিণ এশিয়া থেকে উত্তর ভারতের কাশ্মীর উপত্যকা পর্যন্ত বিন্তীর্ণ ভূ-ভাগ আদিম যুগ থেকে আদি-ঐতিহাসিক কালের প্রাচীন মানব জাতির অব্যাহত ক্রীড়াভূমি ছিল। পঞ্চগড় জনপদটি এই ভৌগলিক পরিসীমার মধ্যে অবস্থিত। হিমালয় পর্বত সানুদেশে এবং সন্নিহিত এলাকায় "কিরাত" জাতি (অনার্য) বসবাস করত, এদের সমশ্রেণীর আদিম মানুষদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো- কাহার, বেহারা, সুনরী, ভূঁইমালি, তাঁতি, দোসাদ, চন্ডাল, হাড়ি, ডোম, মেথর ইত্যাদি। পেশাজীবী হিসেবে এবং মর্যাদার পরিপ্রেক্ষিতে এরা বর্তমানকালে অতি নিম্নশ্রেণী হলেও আদিম অবস্থায় এদের সামাজিক মর্যাদা এতোটা খারাপ ছিল না। ডোম ,চন্ডাল, তাঁতি ইত্যাদি নিম্নবর্ণের মানুষের উল্লেখ রয়েছে চর্যাপদেও । অর্থাৎ অতি প্রাচীনকালে এইসব পেশাজীবী মানুষ বিশেষত উত্তরবঙ্গে বসবাস করত। পঞ্চগড় জনপদে এদের সঙ্গে আদি-ঐতিহাসিক কালে পূর্ব ও দক্ষিণ প্রান্ত থেকে আগত আদি -অষ্ট্রেলীয় মানুষদের সংমিশ্রণ ঘটেছে এবং গড়ে উঠেছে "আদি-অষ্ট্রেলীয়" নৃ-বৈশিষ্ট্য।
পৌরণিকযুগের "নরক রাজা" "কিরাত" জাতিকে বিতাড়িত কের "কামরূপ"-এ আর্যজাতির উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, পঞ্চগড় জেলা ছিল পশ্চিম কামরূপ - এর অভিন্ন অংশ। "বেদ"- এর ব্রাহ্মণভাগে দেখা যায় যে, আর্যগণ কৌশল এবং মিথিলার মধ্যবর্তী "সদানীরা নদী" অতিক্রম করে পূর্বদেশে (কামরূপে) উপস্থিত হয়েছিলেন। "শতপথ ব্রাহ্মণেও" তার উল্লেখ রয়েছে। সারণাচার্যের মতে, (পঞ্চগড় জেলায় প্রবাহিত) "করতোয়া" এবং "সদানীরা" অভিন্ন নদী। অমন সিংহ এবং হেমচন্দ্রের মতে, করতোয়ার নামই "সদানীরা"। পৌরণিককাল থেকে 'কামরূপ ' ক্ষেত্রে (পঞ্চগড় সহ) 'করতোয়া' একটি পবিত্র নদী বলে গণ্য হয়ে আসছে। কথিক আছে, হিমালয় কর্তৃক কন্যা সম্প্রদানকালে মহাদেবের হস্তচ্যুত জল থেকে করতোয়া উদ্ভুত হয়েছিল। সূতরাং প্রায় নিশ্চিত যে, আর্যরা পঞ্চগড় জেলার উপর দিয়েই আরো পূর্বে কামরূপ -কামাখ্যা পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। তারা মিথিলা হয়ে কামরূপে আসেন। বঙ্কিমচন্দ্রের মতেও- কামরূপ একটি প্রাচীন আর্যভূমি। পুরাণাদিতে এই দেশ "অতি পবিত্র" বলে উল্লেখিত আছে। "পান্ডবেরা" মহাপ্রস্থানকালে "লোহিত্যসাগরের" (ব্রহ্মপুত্র) তীর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। অর্জন তার গান্ডীব বিসর্জন দিয়েছিলেন বৃহ্মপুত্র নদের জলে। পৌরণিককালে শ্রীকৃষ্ণ, ভীম, কর্ণ এবং অর্জুনের দিগ্বিজয়ের প্রয়োজনে কামরূপে আগমনের উল্লেখ আছে। এভাবেই কামরূপে তথা পঞ্চগড়ের জনপদেও আর্য সমাগম ঘটে এবং কিছু পরিমাণে হলেও আদি-অষ্ট্রেলীয় রক্তধারার পাশাপাশি "অ্যালপাইন" নৃজাতিক বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়।
বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক "হিউ এন সাং" ৭ম শতকের মধ্যভাগে পঞ্চগড় জেলার প্রান্তদেশীয় কোনো অঞ্চল দিয়ে "কামরূপে" আগমন করেন। ৭ম শতাব্দীতে তিব্বতীয়গণ বঙ্গ ও মগ্ধ আক্রমণ করেন। কামরূপের রাজা ভাস্কর বর্মা তিব্বতীয়দের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। তিব্বতীয়রা অবশ্যম্ভাবীরূপেই পঞ্চগড় জেলার জনপদ দিয়ে অতিক্রম করেছিলেন। ৮১৫-৮৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পাল রাজা দেবপালের রাজত্বকালে এবং কামরূপের রাজা বীরবাহুর সময় হিমালয় পর্বতের উপত্যকাবাসী "কম্বোজ" জাতি "গৌড়" রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। অন্যদিকে, খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে জনৈক শিবোশাসক কম্বোজ বংশীয় রাজা "গৌড়" রাজ্য অধিকার করেন। বর্তমান রংপুর ও পঞ্চগড় জেলার কোচ এবং মেচ প্রভৃতি জাতির লোককে এই কম্বোজ জাতির বংশধর বলে অনুমান করা হয়। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে- পালবংশীয় রাজাগণ কম্বোজ জাতীয় লোকদের ঘন ঘন আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পঞ্চগড় থেকে ১০ মাইল উত্তর-পূর্বাকোণে অবস্থিত বিখ্যাত ভিতরগড় দুর্গটি নির্মাণ করেন।
উল্লেখিত সূত্রগুলো থেকে এ সত্যই উদ্ঘাটিত হয় যে, অতি প্রাচীনকাল থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত পঞ্চগড় জেলায় হিমালয় সন্নিহিত পাহাড়ী অঞ্চল, চীন, তিব্বত, ভূটান প্রভৃতি উত্তরশায়ী দেশ ও জনপদ থেকে জনধারার ক্রমাগত আগমন ঘটেছে এবং গড়ে উঠেছ স্থায়ী বসতি। এদের প্রভাবে "মঙ্গোলীয়" বৈশিষ্ট্য স্বল্পমাত্রায় হলেও এ জেলায় সংমিশ্রিত হয়েছে। পঞ্চগড় জেলার নৃতাত্ত্বিক পর্যালোচনার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে- মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত এবং 'বোডো' ভাষা ব্যবহারকারী কোচ, পলিয়া ও রাজবংশী জনদের ব্যাপক সংখ্যক এ জেলায় বসবাস। নৃতাত্ত্বিক বিচারে এরা একই জাতিভূক্ত কিনা, এ ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন মানববিজ্ঞানী ডঃ উইলিয়াম হান্টার, এইচ বিভারলে, এইচ এইচ রিজলী এবং ই. পোর্টার প্রমুখ। নৃবিজ্ঞানী রমাপ্রসাদ চন্দের মতে- তিব্বতীয় বা মঙ্গোলীয় আকারের কোচ, পলিয়া ও রাজবংশী প্রভৃতি জাতি তিব্বতীয় বা ভূটিয়া আক্রমণকারীগণের অনুচরদের বংশধর বলেই মনে হয়। কোচ ও তিব্বতীয় দুই ভিন্ন জাতি হিসেবে উল্লেখ করেন রংপুর ধর্মসভার সভাপতি যাদবেশ্বর তর্করত্ন। মানববিজ্ঞানী হ্যামিল্টন ও স্যার রিজলী উল্লেখ করেন যে, কোচ, পলিয়া ও রাজবংশী মূলত একই গোষ্ঠীভূক্ত তিনটি শাখা।
কিন্তু রাজবংশী বর্তমানে নিজেদের কোচ জাতির অন্তর্ভূক্ত বলে পরিচয় দিতে অস্বীকার করেন। জলপাইগুড়ি জেলা গেজেটিয়ারের ১৮৭২,১৯০১,১৯১১ ও ১৯৩১ সালের পরিসংখ্যানগুলোতে 'রাজবংশী'দের প্রধান সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু কোচ ও পলিয়া জাতির কোনো তথ্য উল্লেখিত পরিসংখ্যাণে না দেওয়ার কারণ হচ্ছে- এরা নিজেদের ঐ পরিচয় আর স্বীকার করছেন না। বরং অনেকেই ক্ষত্রিয় বা হিন্দু বলেই দাবী করেন। ১৯৬১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায় যে, বোদা, আটোয়ারী, দেবীগঞ্জ ও পঞ্চগড় থানায় কোচ, পলিয়া ও রাজবংশীর সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার শতকরা চল্লিশভাগ আর হিন্দুদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত নগণ্য। স্মরণ করা যেতে পারে যে, পঞ্চগড় জেলা ছিল দীর্ঘদিন কামরূপ ও কোচবিহার রাজ্য এবং জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত- যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী ছিলেন কোচ, পলিয়া ও রাজবংশীগণ। সূতরাং এ সত্য স্বীকার না করে উপায় নেই যে, এ জেলার অমুসলিম অধিবাসীদের অধিকাংশই "রাজবংশী" এবং রাজবংশীয় আবরণে কোচ ও পলিয়াও বটে। দৃষ্টান্ত হিসেবে তাকানো যায় "বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট" গেজেটিয়ারের ১৯৩১ সালের পরিসংখ্যানের প্রতি- যেখানে প্রদর্শিত হয়েছে নিম্নরূপ তথ্যঃ
জাতি তেঁতুলিয়া বোদা পঞ্চগড় দেবীগঞ্জ
ব্রাহ্মণ ১৩৯ ২১১ ১১১ ১৫৪
কায়স্থ ৮৫ ৯৪১ ৪২ ৩৭৫
রাজবংশী ৬৯৮৫ ৩০০১৫ ১৩৩০৮ ৩৫২৬৯

বিভিন্ন পরিসংখানে কোচ ও পলিয়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রদর্শিত হয়েছে। জেলা সৃষ্টির পূর্বে ঠাকুরগাঁও মহকুমায় (পঞ্চগড় সহ) পলিয়া জনসংখ্যা ছিল ৫০ হাজার। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশ কোচ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা- ১,৫৬,০০০। উভয় তথ্য থেকে এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়া চলে যে, কোচদের কোচবিহার এবং বর্তমান বৃহত্তর রংপুর জেলার পার্শ্ববর্তী জেলা হিসেবে পঞ্চগড়েও 'পলিয়া' ও 'কোচ' জাতি উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বসবাস করে। পঞ্চগড় জেলায় বর্তমানে(১৯৮৪) হিন্দু সংখ্যা দেখানো হয়েছে এক লক্ষের কিছু বেশী। বস্তুত, এদের অধিকাংশই যে কোচ, পলিয়া ও রাজবংশী জাতিভুক্ত, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, আজ তারা নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দিলেও হিন্দু ধর্মের বাঁধনটা তাদের অত্যন্ত শিথিল। বিধবা বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ প্রথা বহু প্রাচীনকাল থেকেই তাদের মধ্যে প্রচলিত। আহার-বিহার, চাল-চলন, পূজা-পার্বণ ইত্যাদি ব্যাপারে এরা হিন্দুদের থেকে স্বতন্ত্র। তারা হিন্দু দেবদেবীদের গ্রহণ করলেও তাদের মধ্যে ভিন্ন রীতিনীতি ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান। আজও "কালিপূজা" এদের সর্ববৃহৎ উৎসব। বিষ্ণু এদের কাছে তেমন কোনো বিশিষ্ট দেবতা নয়। হিন্দুদের সর্ববৃহৎ উৎসব 'দুর্গা' পূজার তেমন কোন প্রভাব এদের মধ্যে নেই।
কোচ ও রাজবংশীদের উৎপত্তির ইতিহাসটিও এ প্রসঙ্গে জেনে নেয়া যায়।- প্রাচীন কামরূপ রাজ্য অহোম ও কোচ জাতি দ্বারা অধিকৃত হয়। অহোমরা পূর্ব কামরূপ এবং কোচরা পশ্চিম কামরূপ (বর্তমান কোচবিহার, রংপুর ও পঞ্চগড়) দখল করে নেয়। পরিশেষে কোচেরা কেন্দ্রীভূত হয় কোচবিহার ও বৈকুন্ঠপুরে (জলপাইগুড়ি)। কোচদের প্রধান ও প্রথম নায়কের নাম "হাজো"। তিনি "খেন" জাতিদের পরাস্ত করে ১৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে কোচরাজবংশের সৃষ্টি করেন এবং প্রায় ৪৫০ বছর রাজত্ব করে তার উত্তরসূরীগণ। "হাজো" ছিলেন "বোডো" জাতির মানুষ।প্রাচীনকালে 'বোডা'রা 'পাটকই' পাহাড়ের মধ্য দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের কূল ধরে উত্তর-পূর্ব আসামে এসে পৌঁছেছিলেন। আসামের পশ্চিমভাগ এবং নেপালের 'তরাই' ভূমির পূর্বভাগ হাজোর অধীনে ছিল। বস্তুত উভয় অঞ্চল বর্তমানে পঞ্চগড় জনপদের সংলগ্ন। কোচ নায়ক হাজোর দৌহিত্র শিশু ও বিশু শিশ্বসিংহ নাম ধারণ করে যথাক্রমে বৈকুন্ঠপুর (জলপাইগুড়ি) ও কোচবিহারের রাজা হন। এভাবেই তারা একদিকে উপজাতির পর্যায় থেকে 'রাজবংশে' উন্নীত হন এবং হিন্দুধর্ম গ্রহণ করে 'কোচ' নাম ঘুচিয়ে ফেলেন। সেই থেকে 'রাজবংশী' নামে উৎপত্তি। রাজবংশীগণ 'ক্ষত্রিয়' বলেও নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকেন। বস্তুত, পঞ্চগড় জেলার লৌকিক ধর্মবিশ্বাস, প্রথা-উৎসব এবং সাংস্কৃতিক পরিচর্চায় কোচ, পলিয়া ও রাজবংশী- এই তিন জনগোষ্ঠীর অবদান সর্বাধিক। অনুমান করা হয় যে, এদের মধ্যে থেকেই ইসলাম ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়া সবচেয়ে বেশি সম্পন্ন হয়েছে।
নৃ-বিজ্ঞানী গৌতম শংকর রায় দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি (বর্তমান পঞ্চগড় জেলাসহ) এলাকার রাজবংশীদের নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করেছেন এভাবে- শিরাঙ্ক ৭৫.৮ সে.মি., নাসাংক-৭২.৪ সে.মি. এবং উচ্চতা-১৬০.৩ সে.মি.। পক্ষান্তরে নৃ-বিজ্ঞানী রিজলী বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর গড় নৃ-বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করেছেন এভাবে- মুসলিম শিরাঙ্ক-৭৮.০ সে.মি., নাসাংক-৭৭.৫ সে.মি. এবং উচ্চতা ১৬৩.৪ সে.মি.। পঞ্চগড়ের মুসলিম ও রাজবংশী তথা হিন্দু জাতির নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যও মোটামুটি উল্লেখিত সূচাকাঙ্কের অনুরূপ। 'অ্যালপাইন' নরগোষ্ঠীর আরেকটি ধারা মুসলিম অধিকারের পর পঞ্চগড়ের জনপদে আগমন করে তাদের রক্তধারার মিশ্রণ ঘটে স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে। এরা মূলত বহিরাগত মুসলিম শাসক, সৈন্য, কর্মচারী ও ধর্মপ্রচারক। পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী ও তেঁতুলিয়া থানার বেশ কিছু সংখ্যক মুসলিম পরিবারের মধ্যে এবং বিচ্ছিন্নভাবে অন্যান্য থানার কিছূ কিছু পরিবারের মধ্যেও এই জনগোষ্ঠীর "জন"দের দেখা যায়। এদের গৌর বর্ণ, উন্নত নাক, প্রশস্ত ললাট, ঋজু ও কোমল চুল এবং মাথার খুলির গঠন স্থানীয় অন্যান্য অধিবাসীদের চেয়ে পৃথক। বস্তুত বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার মতো পঞ্চগড় জেলার মুসলিম জাতি তিনটি উপাদানের সংকর- (১) বিদেশী বা আগন্তুক মুসলিম উপাদান, (২) মিশ্র উপাদান এবং (৩) ধর্মান্তরিত উপাদান।
উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সংঘটিত সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়ে গেলে বিপর্যন্ত বহু সিপাহী তেঁতুলিয়া সংলগ্ন ঘন জঙ্গলসহ নেপাল-ভূটান পর্যন্ত অঞ্চলে পলায়ন করেন এবং আত্মগোপন করে থাকেন। ফাঁসি দেওয়া, সিপাহীপাড়া প্রভৃতি গ্রাম সিপাহী বিপ্লবের স্মৃতিবহ। "ফাঁসি দেওয়া" নামক স্থানে সিপাহীদের ফাঁসি দেওয়া হয়। এই জনপদে ফকির মজনু শাহ, ভবানীপাঠক প্রভৃতি, ফকির ও সন্ন্যাসী নেতার নেতৃত্বে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন সংঘটিত হয়। সন্ন্যাসী কাটা, সন্ন্যাসী পাড়া, দেবীগঞ্জ, দেবীডোবা প্রভৃতি অঞ্চলের নামকরণ সেই স্মৃতিকে ধারণ করেই করা হয়েছে। 'সন্ন্যাসীকাটা'য় ধৃত সন্ন্যাসীদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ফকির ও সন্ন্যাসী বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী অনেক ফকির ও সন্ন্যাসীও এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। এছাড়াও ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর 'জলপাইগুড়ি' জেলা থেকে এবং ১৯৫৩ সাল থেকে পূর্ববঙ্গের নোয়াখালী, ঢাকা, পাবনা ও ময়মনসিংহের বিপুল সংখ্যক মানুষ পঞ্চগড় জেলায় এসে স্থায়ীভাবে থেকে যান।
উল্লেখিত জনপ্রবাহ ধীরে ধীরে স্থানীয় জনধারার সঙ্গে নিজেদের মধ্যে মিশিয়ে ফেলেন। বহিরাগত এই জন প্রবাহের মধ্যে অ্যালপাইন, মঙ্গোলীয়, দ্রাবিড়, আদি-অষ্ট্রেলীয় প্রভৃতি মিশ্র উপাদান।পঞ্চগড় জেলার নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বিনির্মাণে এদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত উত্তরবঙ্গে অধিকাংশ মানুষের নৃবৈশিষ্ট্যের প্রায় অনুরূপ "অষ্ট্রিক-মঙ্গোলীয়" এবং "অ্যালপাইন" নরগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে পঞ্চগড় জেলার অধিবাসীদের মিশ্র মানব বৈশিষ্ট্য। তথ্যসূত্রঃ -নাজমুল হক [ পঞ্চগড় জেলার ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি, বাংলা একাডেমী, ঢাকা]

পঞ্চগড়ের রাষ্ট্রীয় সীমানা

২৬ ডিগ্রি ২০মিনিট উত্তর অক্ষাংশে এবং ৮৮ ডিগ্রি ৩৪ মিনিট পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত পঞ্চগড় "জেলা" হিসেবে নবগঠিত ও আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও এর পারিপার্শ্বিক ভৌগলিক অবস্থান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৪৭ সালে স্যার সিরিল রেডক্লিফ কর্তৃক নির্দেশিত এই জেলার সীমান্ত রেখা অত্যন্ত আঁকাবাঁকা ও ভঙ্গুর। পঞ্চগড় জেলার তিনদিকেই ভারতীয় সীমান্ত। এই সীমান্ত অঞ্চল ১৮০মাইল বা ২৮৮ কিলোমিটার। জেলার মোট আয়তন ৫৯৩.২৪ বর্গমাইল। এ জেলার উত্তরে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা, উত্তরপূর্ব ও পূর্বে জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলা এবং বাংলাদেশের নীলফামারী জেলা, পশ্চিমে ভারতের পূর্ণিয়া ও উত্তর দিনাজপুর এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্বে ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলা অবস্থিত। রেডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার ৩০টি থানার মধ্যে ০৯টি সম্পূর্ণ এবং ০১টি আংশিকভাবে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। অবশিষ্ট ২০টি থানার মধ্যে পোরসা, পত্নীতলা ও ধামইরহাট থানাকে রাজশাহী জেলার অন্তর্ভূক্ত করা হয়। একই সময় জলপাইগুড়ি জেলার দেবীগঞ্জ, বোদা, তেঁতুলিয়া ও পঞ্চগড় থানাকে কেটে যুক্ত করা হয় দিনাজপুর জেলার সঙ্গে। স্যার রেডক্লিফ ১৯৪৭ সালে দিনাজপুর জেলার অংশ হিসেবে পঞ্চগড় অঞ্চলের যে সীমানা নির্দেশ করেন তা হলো- A line shall be drawn along the boundary between the thana of "Phansidewa" in the dristrict of Derjeeling and the thana "Tetulia" in the district of "Jalpaiguri" from the point where the boundary meets the provinence of Bihar and then along the boundary between the thana of 'Tetulia' and 'Rajgamg' : The thanas of "Panchagarh" and "Rajgang" : and the thana of "Panchagarh" and "Jalpaiguri"; and shall then continue along the northern corner of the thana "Debigang", to the boundary of the state of "Cooch-Bihar". The district of 'Darjeeling' and so much of the district of 'Jalpaiguri' as lines north of this line shall belong to west Bengal. (বিহার প্রদেশের সীমানা যেস্থানে দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলার সীমানাকে স্পর্শ করেছে, সেখান থেকে একটি রেখা দার্জিলিং জেলার "ফাঁসিদেওয়া" থানা এবং জলপাইগুড়ি জেলার তেঁতুলিয়া থানার মধ্য দিয়া টানা যেতে পারে। এরপর রেখাটি তেঁতুলিয়া ও রাজগঞ্জ থানার মধ্যদিয়ে এবং পঞ্চগড় ও রাজগঞ্জ থানা, অতঃপর পঞ্চগড় এবং জলপাইগুড়ি থানার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে, দেবীগঞ্জ থানার উত্তর কোণকে স্পর্শ করে কোচবিহার রাজ্যের সীমানা পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা যেতে পারে। দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা দুটি এই রেখার উত্তর প্রান্তে অবস্থান করতে এবং তা হবে ভারতীয় ভূ-খন্ডের অন্তর্ভূক্ত।) রেডক্লিফ মিশন কর্তৃক পঞ্চগড় থানার সীমানা নির্দেশ করতে গিয়ে জলপাইগুড়ি জেলার ১২নং বেরুবাড়ি ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় জটিলতা। সে সময় সমস্ত ইউনিয়নকে তৎকালীন পাকিস্তানভূক্তির দাবী উঠেছিল। কিন্তু কার্যত তা বাস্তবায়িত হয়নি। এই অমীমাংসিত বিষয়টি দু'দুবার রাষ্ট্রীয় শীর্ষ পর্যায়ে চুক্তি দ্বারা নির্দেশিত হয়। প্রথমত ,"নেহেরু-নুন" চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।দ্বিতীয়ত, "মুজিব-ইন্দিরা" চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৬ মে ১৯৭৪ সালে।


নেহেরু-নুন চুক্তি- ১৯৫৮


This will be so divided as to give half of the area of Pakistan the other half adjacent to India being retained by India. The division of Berubari-12 will be horizontal, starting from the north-east corner of Debigang thana. The dividsion should be made in such a manner that the Kooch-Bihar enclaves between Panchagarh thana of East Pakistan and Berubarie Union No-12 of Jolpaiguri thana of west Bengal will remain connected as at Present with Indian territory and will remain with India. The "Kooch- Bihar" enclaves lower down between Boda thana and Berubari Union-12 will be exchanged along with the general exchange of enclaves and will go to Pakistan.


মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি-১৯৭৪


India will retain the southern half of south Berubari Union-12 and the adjacent enclaves, measuring an area of 2.64 square miles approximately, and in exchange Bangladesh will retain the "Dahagram" and "Angorpota" enclaves. India will lease in Perpetity to Bangladesh an area of 178m. X 85m. near "Tin Bigha" to connect "Dahagram with "Panbari" mouza (PS. Patgram) of Bangladesh.
"নেহেরু-নুন" চুক্তিতে বেরুবাড়ী ১২নং ইউনিয়ন পূ্র্ববৎ থাকার কথা উল্লেখ রয়েছ। পক্ষান্তরে, ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাঢ়ী ইউনিয়নের অর্ধাংশের পরিবর্তে বাংলাদেশকে "দহগ্রাম" ও "আঙ্গুরপোতা" ছিটমহল প্রদানের কথা বলা হয়েছে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাক-ভারত বিভক্তির সময় বর্তমান পঞ্চগড় জেলার ৪টি থানা তৎকালীন জলপাইগুড়ি জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে তৎকালীন দিনাজপুর জেলার সঙ্গে জুড়ে দেয়ার ফলে যথেষ্ট হেরফের হয়েছে রাষ্ট্রীয় সীমানার।
থানা সাল আয়তন ১৯৬১ সালে আয়তন ১৯৯০ সালে আয়তন
বোদা ১৮৭২ ৪৭৫ বর্গমাইল ১৬৬ বর্গমাইল ১৪০ বর্গমাইল
পঞ্চগড় ১৯২১ ৯৬ বর্গমাইল ১০৩ বর্গমাইল ১২০ বর্গমাইল
দেবীগঞ্জ ১৯২১ ১১১ বর্গমাইল ১১৯ বর্গমাইল ১১৯ বর্গমাইল
তেঁতুলিয়া রাজগঞ্জ ১৯০১ ৩২৪ বর্গমাইল ৭৪ বর্গমাইল ৭৪ বর্গমাইল
আটোয়ারী ------ --------- ৮১ বর্গমাইল ৮১ বর্গমাইল
উল্লেখিত পরিসংখ্যান নির্দেশ করে যে, বোদা ও তেঁতুলিয়া থানার আয়তন ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। পঞ্চগড় ও দেবীগঞ্জ থানার আয়তন ছিল মোটামুটি স্থিতিশীল। ১৯৬১ সালের পর পুনরায় বোদা ও পঞ্চগড় থানার আয়তন ও সীমানার উল্লেখযোগ্য রূপান্তর পরিলক্ষিত হয়।
পঞ্চগড় জনপদের ভৌগলিক ও রাষ্ট্রীয় পরিচয় সম্পর্কে বিভিন্ন পুরাণ গ্রন্থে অভাস ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এই ভূ-খন্ড প্রাচীনকালে প্রাগজ্যেতিষ, কামরূপ, রত্নপীঠ, সৌমারপীঠ, পুন্ডবর্ধন এবং মধ্যযুগে কোচবিহার রাজ্যের অবিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে বিদ্যমান ছিল। প্রাগৈতিহাসিক কালে পঞ্চগড়সহ কামরূপ রাজ্যের আয়তন ও সীমানা সম্পর্কে "কালিকা পুরাণে" , "কামাখ্যাতন্ত্রে" ও "যোগিনীতন্ত্রে" বিবরণ পাওয়া যায়। কালিকা পুরাণে লিপিবদ্ধ রয়েছে- নারায়ণ পূর্বদিকে ললিতকান্তার এবং পশ্চিমে পঞ্চগড় জনপদের মধ্যে প্রবাহিত "করতোয়া" নদীর মধ্যবর্তী ভূ-খন্ড রাজা নরককে প্রদান করেছিলেন। এটিই প্রাচীন কামরূপ রাজ্য। তার পূর্বে ঐ অঞ্চলে কর্কমকায় "কিরাত" জাতি বসবাস করতো। নেপালের "তরাই" অঞ্চলে (তেঁতুলিয়া থানার কিয়দংশ) বসবাস করতো অনেক "কিরাত" আদিবাসী। পঞ্চগড় জনপদের "কীচক" জনগোষ্ঠী সম্ভবত কিরাত জাতির উত্তর পুরুষ। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমী তাঁর ভূ-বৃত্তান্তমূলক গ্রন্থে "কিরাদিয়া" জাতির উল্লেখ করেছেন। বিশেজ্ঞগণ "কিরাদিয়া"-কে "কিরাত" জাতি বলে মনে করেন এবং এদেশের বাসস্থান হিসেবে নির্দেশ করেন পঞ্চগড় জনপদসহ "কামরূপ রাজ্যকে"।
"যোগিনীতন্ত্রে" কামরূপ রাজ্যের সীমা নির্দেশ করা হয়েছে এভাবে- এই রাজ্য "করতোয়া" নদী থেকে দিবকরবাসিনী পর্যন্ত প্রসারিত; এদেশের উত্তরে 'কঞ্জগিরি'- পশ্চিমে পঞ্চগড়ের করতোয়া নদী, পূর্বদিকে দিক্ষ নদী, দক্ষিণে বৃহ্মপুত্র (লৌহিত্য) এবং লাক্ষা নদীর মিলনস্থল অবস্থিত।-এই ভূ-খন্ডটি ত্রিভূজাকৃতি। দৈর্ঘ্যে শত যোজন অর্থাৎ আটশত মাইল এবং প্রস্থে ত্রিশ যোজন অর্থাৎ দুইশত চল্লিশ মাইল। এই সীমারেখা প্রমাণিত করে যে, বর্তমান ভূটান রাজ্যের কিছু অংশ এবং রংপুর, কোচবিহার ও পঞ্চগড় ছিল কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভক্ত।
গুণাভিরাম বড়ুয়া সংকলিত "আসাম বুরুঞ্জী" (১৯৮৪) গ্রন্থেও বলা হয়েছে যে, ব্রহ্মপুত্র নদের তীরভূমি, রংপুর, কোচবিহার এবং জলপাইগুড়ি(পঞ্চগড়) সম্পূর্ণরূপে ছিলো কামরূপ রাজ্যের অধীন। সমগ্র উত্তরবঙ্গ প্রাচীনকালে "পুন্ডবর্ধন" নামে পরিচিত ছিল। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে "পুন্ডবর্ধন" গুপ্ত রাষ্ট্রের একটি সমৃদ্ধশালী ভুক্ততে পরিনত হয়। পঞ্চম শতকের দামোদরপুর লিপি অনুযায়ী জানা যায় যে, পুন্ডবর্ধন এক সময় বিস্তৃত ছিল হিমালয় শিখর থেকে সমুদ্র পর্যন্ত। বিহার রাজ্যের কুশী বা কৌশিক নদী এবং করতোয়া নদীর মধ্যবর্তী ভূ-ভাগই ছিল প্রাচীন পুন্ড্রজনপদ। সুতরাং পঞ্চগড় জনপদ যে পুন্ড্রবর্ধন ভূক্তির আয়তনভূক্ত ছিল, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
নবম শতাব্দীর রাজা বনমালের তাম্রশাসনে "ত্রিস্রোতা" নদীর (চিলাহাটী, দেবীগঞ্জ অঞ্চলের বুড়াতিস্তা) পশ্চিমে ভূমি দান করার কথা উল্লেখ রয়েছে। স্থানটি নিঃসন্দেহে পঞ্চগড় জনপদে অবস্থিত। চতুর্দশ শতাব্দীর গৌড়েশ্বর সেকান্দার শাহের মুদ্রায় "কামরূপ" ওরফে চাউলিস্তান" মুদ্রিত রয়েছে। পঞ্চগড় জনপদে "চাউলিয়া", "চাউলহাটি" বহুল ব্যবহৃত ও প্রচলিত শব্দ। পঞ্চদশ শতাব্দীর হোসেনশাহী মুদ্রায় "কামরূপ" ও "কামতা"-দুটি দেশের নাম লেখা রয়েছে। সুলতান হোসেন শাহ পূর্ণিয়া থেকে এসে পঞ্চগড়ের উপর দিয়ে কামরূপ অভিযানে অগ্রসর হন এবং সেদেশ জয় করেন। "আইন-ই-আকবরী" ও "বাহরিস্তান-ই-গাইবী" গ্রন্থে "কোচ" দেশ এবং তার মধ্যে "কামতা" ও "কামরূপ" রাজ্যের নাম উল্লেখ রয়েছে। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রচিত শাজাহানামায়" কামরূপ রাজ্যের পশ্চিমার্ধের নাম "কামতার" পরিবর্তে :কোচবিহার" এবং পূর্বাঞ্চলের "কামরূপ" স্থলে 'কোচ' 'হাজো' উল্লেখিত হয়েছে। বস্তুত, আধুনিককালের রংপুর ও জলপাইগুড়ি (পঞ্চগড় সহ) অঞ্চলের কোচ অধিবাসী- যারা ঐতিহাসিককালে ছিল উত্তরবঙ্গ বিজেতা মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী সম্ভূত। তাদের নামে পশ্চিম কামরূপ দেশের নাম হয়েছে "কোচবিহার"। পঞ্চগড় জনপদ প্রায় ৪শত বছর ব্যাপী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ছিল কোচবিহার রাজ্যের শাসনাধীন।
বস্তুত, কামরূপ দেশ বিভক্ত ছিল চারভাগে- রত্নপীঠ, কামপীঠ, স্বর্ণপীঠ এবং সৌমারপীঠ। কালিকা পুরাণের মতে যে স্থানের নাম সৌমারপীঠ, ইতিহাসের মতে তারই নাম "কামতা" রাজ্য। পঞ্চদশ শতকের প্রথমভাগে খেন বংশীয় রাজা নীলধ্বজ স্থাপন করেছিলেন এই রাজ্য। নীলধ্বজ পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া থানাধীন দেবনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে ডঃ হেমিল্টন বুকানন উল্লেখ করেন। পঞ্চগড় জনপদ সুস্পষ্টভাবেই "রত্নপীঠ", সৌমারপীঠ বা "পশ্চিম কামরূপ" নামে পরিচিত ছিল। উইলিয়াম হান্টার এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন "করতোয়া" নদী রামায়ণ- মহাভারতের সময়কাল থেকে "বাংলা" এবং "কামরূপ" রাজ্যের সীমানা নির্দেশ করতো। সে হিসেবে বিভিন্ন সময় তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড় ও দেবীগঞ্জ থানার পূর্বাঞ্চল কামরূপ ও কোচবিহার রাজ্যের এবং করতোয়া নদীর পশ্চিমাঞ্চল "বাংলা" বা "গৌড়" রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল।
মুসলিম অধিকারের প্রথম দিকে গঙ্গা, করতোয়া ও মহানন্দা নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত ভূ-ভাগ নিয়ে খুব সম্ভব নবগঠিত তূর্কী-লখনৌতি রাজ্যের উপরিভাগ গঠিত ছিল (১২০৬খ্রিঃ)। বর্তমান পঞ্চগড়- আটোয়ারী পাকা সড়কের কাছাকাছি স্থানে করতোয়া নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী স্থান বরাবর ছিল লখনৌতি (গৌড়) রাজ্যের উত্তর সীমারেখা। পূর্বদিকে দেবীগঞ্জ থানার পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত এই সীমারেখা বিস্তৃত ছিল বলে অনুমান করা যায়। বখতিয়ার খলজির রাজ্য সীমা উত্তরে পঞ্চগড়ের উপর দিয়ে প্রবাহিত করতোয়া নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে ধরা যেতে পারে। করতোয়া নদীর উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ তেঁতুলিয়া থানার ভজনপুর অঞ্চল থেকে উপরের অংশ বাংলাবান্ধা পর্যন্ত পাল, সেন ও মুসলমান শাসনামলে গৌড়ের অন্তর্ভূক্ত ছিল। এ ভূ-খন্ড ছিল গৌড় রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চল।
মোঘল সুবাদার এবাদত খাঁ (১৬৮০ খ্রিঃ) দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘোটে ফৌজদার নিযুক্ত হওয়ার পর কোচ রাজ্যের বার বার আক্রমণ এবং অনুপ্রবেশ স্থায়ীভাবে প্রতিহত ও রুদ্ধ করার লক্ষ্যে সরকার ঘোড়াঘাটে নির্মাণ করেন অনেকগুলো সামরিক ঘাটি ও চৌকি। সেই সব সামরিক স্থাপনায় মোতায়েন করা হয় সার্বক্ষণিক সেনা সদস্য। শত্রু সেনার গতিবিধি লক্ষ্য রাখার জন্য সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমুহে নির্মাণ করা হয় "অবজারভেশন টাওয়ার" বা মাটির সুউচ্চ বুরুজ। কোথাএ কোথাও স্থাপন করা হয় কোচ ও মোঘল রাজ্যের সীমানা নির্দেশক সুদীর্ঘ, সুউচ্চ মাটির প্রাচীর। এগুলে জনসাধারণের নিকট "বান্দ" নামে পরিচিত। অর্থাৎ "বাঁধ 'বা আল।
করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরবর্তী গৌড় রাজ্য অর্থাৎ মোঘল, সাম্রাজ্যের একটি কৌণিক প্রত্যন্ত অঞ্চল তেঁতুলিয়া থানার "বাংলাবান্ধা" এ ধরণের একটি বিখ্যাত সীমান্ত প্রাচীর। এই গ্রামে পূর্ব-পশ্চিমে সম্প্রসারিত একটি দীর্ঘ মাটির প্রাচীর নির্মাণ করা হয় এবং বন্ধ করে দেওয়া হয় মোঘল শাসিত "বাংলা" ও "কোচ-কামতা" রাজ্যের মধ্যকার সীমান্ত। বলাবাহুল্য, বাংলাবান্ধার দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল ছিল "কোচ ও কামতা" রাজ্যের অধীন। পক্ষান্তরে, অদূরে প্রবাহিত করতোয়া নদীর পশ্চিমাঞ্চল (ভজনপুর, তেঁতুলিয়া ও আটোয়ারী) ছিল মোঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। কামতা ও কোচ রাজ্যকে (পঞ্চগড় জনপদের পূর্বাঞ্চল) বলা হতো বাংলার বহির্ভূত রাজ্য। মোঘলরা এ রাজ্য অধীকার করতে সক্ষম হলেও ক্ষমতার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য উভয় দেশের মধ্যে লেগে থাকতো যুদ্ধ, বিরোধ ও সংঘর্ষ।
সামগ্রিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, পঞ্চগড় জেলার বর্তমান ভূ-খন্ড প্রাচীনকাল থেকে যথাক্রমে প্রাগজ্যোতিষ, কামরূপ, কামতা, গৌড়, কোচবিহার, দিল্লীর সাম্রাজ্য এবং ব্রিটিশদের অধীনে শাসিত হয়। পাশাপাশি, এই জনপদের ভৌগলিক অবস্থান ছিল মগ্ধ, অযোধ্যা, বিহার, নেপাল, সিকিম, ভূটান, তিব্বত, আসাম ইত্যাদি রাজ্যের নিকটবর্তী। এটি ছিল সমকল সময় এবং সকল রাজ্যের সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত অঞ্চল। সে -কারণে পঞ্চগড় সামরিক দিক থেকে সব সময়ই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যসূত্র- নাজমুল হক, [পঞ্চগড় জেলার ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।]

রবিবার, ৬ জুন, ২০১০

পঞ্চগড় জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য

আধুনিক পঞ্চগড় জনপদটি আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও এর প্রাচীন ও প্রাগৈতিহাসিক ইতিবৃত্ত অত্যন্ত সম্বদ্ধ। অতি প্রাচীন ও প্রাগৈতিহাসিক ইতিবৃত্ত সম্বদ্ধ করেছে হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের সর্বোত্তরের এই জনপদটিকে। পঞ্চগড় জেলার নামই এর যথার্থ স্বাক্ষ্য বহন করে। হিন্দু ও বৌদ্ধ যুগে পুন্ড্র বর্ধন নগরীর অনতিদূরেই ছিল আজকের পঞ্চগড়ের অবস্থান। ভিন্নমতে, গৌড় রাজ্যকে এক সময় বলা হতো পঞ্চগৌড়। আর পঞ্চগৌড় হতেই প্রাকৃত ভাষার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী না-কি পঞ্চগড়ের নামকরণ। অবশ্য বহুল প্রচলিত মত হলো- ভিতরগড়, মিরগড়, হোসেনগড়, রাজনগড় ও দেবেনগড়- এই পাঁচটি গড় অর্থাৎ মাটির তৈরী দূর্গ এর নামানুসারেই পঞ্চগড় নামটির উৎপত্তি। পঞ্চগড় জেলার বর্তমান ভূ-খন্ড প্রাচীনকাল থেকেই যথাক্রমে প্রাগজ্যোতিষ, কামরূপ, কামতা, গৌড়, কুচবিহার, দিল্লীর সাম্রাজ্য ও বৃটিশদের শাসনাধীনে ছিল। বৃটিশ শাসনামলে পঞ্চগড় জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ১৯১১-১৯১২ খ্রিস্টাব্দেই একটি পূর্ণাংগ থানায় উন্নীত হয়। ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির সময় বর্তমান পঞ্চগড় জেলার ৪টি থানা জলপাইগুড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিনাজপুর জেলার অন্তর্ভূক্ত করা হয। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৯সালে এখানে স্থাপিত হয় মুন্সেফ, ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট, পুলিশ ইন্সপেক্টর ও সার্কেল অফিস। অতঃপর ঠাকুরগাঁও মহকুমার আটোয়ারী থানাকে বোদা, দেবীগঞ্জ, পঞ্চগড় ও তেঁতুলিয়ার সাথে যুক্ত করে পঞ্চগড় মহকুমা গঠিত হয় ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারী। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারী পঞ্চগড় জেলায় উন্নীত হয়। ১৯৮৪ সালে জেলা হবার পর ১৯৮৫ সালে পঞ্চগড় সালে পঞ্চগড় পৌরসভার স্বীকৃতি পায়। ১৭৬৩-১৮০০ সালৈ বৃটিশবিরোধী সন্ন্যাসী আন্দোলন, ফকির বিদ্রোহ এখানেই বিস্তার লাভ করে। এ জেলা থেকেই ১৯৪৬ সালে তেভাগা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে এ অঞ্চলের জনগণের বীরোচিত ভূমিকা তেঁতুলিয়াকে মুক্তাঞ্চলে পরিণত করে। পঞ্চগড়ের লোক সংস্কৃতিতেও রয়েছে এক নিজস্ব অনন্য বৈশিষ্ট্য। প্রাচীনকাল হতে আজ অবধি সমভাবেই আদৃত হয়ে আসছে এখানকার "ধোকড়া শিল্প"। উত্তরবঙ্গীয় উপভাষার অন্তর্গত হলেও পালি, প্রাকৃত, প্রাচীন ও মধ্যবাংলা এবং ব্রজবুলি-আসামী-হিন্দী-বিহারী ইত্যাদি শব্দগুচ্ছের উপস্থিতি পঞ্চগড়ের আঞ্চলিক ভাষায় এনে দিয়েছে ব্যাপক স্বাতন্ত্র্য। সীমান্ত পরিবেষ্টিত এ জেলায় বিস্তর নৃ-তাত্ত্বিক বৈচিত্র পরিলক্ষিত হয়। মুসলিম ও হিন্দু প্রধান জনধারা ছাড়াও রাজবংশী, কোচ, পলিঢা, সাঁওতাল, ওঁরাও, হাড়ি, বেহারা প্রভৃতি আদিবাসীর মিশ্র রূপায়ন দৃঢ় করেছে পঞ্চগড়ের নৃ-তাত্ত্বিক ভিত্তিকে। করতোয়া , মহানন্দা, চাওয়াই, ভেরসা, তালমা, পাথরাজ, ডাহুক বিধৌত এই পঞ্চগড়েই জন্মেছেন ডাঃ সলিমুল্লাহ, গমির উদ্দীন প্রধান, মির্জা গোলাম হাফিজ, এ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম, কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ, এ্যাডভোকেট আযুবউল হক, ব্যারিষ্টার মুহাম্মদ জমিরউদ্দীন সরকার, মোঃ মোজাহার হোসেন, নাজিমুল ইসলাম ও মোবারক আলীর মতো ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব। বর্তমানে পঞ্চগড় জেলা ৫টি উপজেলা, ২টি পৌরসভা, ৪৩টি ইউনিয়ন এবং ৮৬২টি গ্রাম নিয়ে গঠিত। জেলায় ১২টি ছিটমহল রয়েছে। উপজেলাগুলো হচ্ছে- পঞ্চগড় সদর, বোদা, আটোয়ারী, দেবীগঞ্জ ও তেঁতুলিয়া। পৌরসভা ২টি হচ্ছে- পঞ্চগড় পৌরসভা ও বোদা পৌরসভা। ২০০৪ সালে বাংলাবান্ধায় স্থাপিত একটি পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর নিঃসন্দেহে জেলার গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে। ভূ-গর্ভস্থ হতে উত্তোলিত পাথর, মোটা বালি ও অতি সম্প্রতি পঞ্চগড়ের চা-শিল্প, কমলা চাষ, পোল্ট্টি ফার্ম এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে যোগ করেছে এক ভিন্নমাত্রা। পঞ্চগড় জেলার দর্শনীয় স্থান সমুহের মধ্যে রয়েছে- ভিতরগড়, বদেশ্বরী গড়, বদেশ্বরী মন্দির, মির্জাপুর শাহী মসজিদ, ছেপড়াঝাড় পাহাড়ভাঙ্গা মসজিদ, শালডাঙ্গা গোলকধাম মন্দির, বার আউলিয়ার মাজার, তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো, পঞ্চগড় মহিলা কলেজ রকস্ মিউজিয়াম, বাংলাবান্ধ স্থল বন্দর, তেঁতুলিয়া জিরো পয়েন্ট। [ তথ্যসূত্রঃ (১) জেলা উন্নয়ন পরিক্রমা (২০০১-২০০৫) পঞ্চগড়, গণযোগাযোগ অধিদপ্তর, তথ্য মন্ত্রণালয়। (২) সচিত্র বাংলাদেশ, মার্চ ২০০৮খ্রিস্টাব্দ, ফাল্গুন-চৈত্রঃ১৪১৪। (৩) পঞ্চগড় জেলার ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি, নাজমুল হক, বাংলা একাডেমি, ঢাকা। ]