১৯৪৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত এবং বর্তমানে পূর্ণিয়া, পশ্চিম দিনাজপুর, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলা পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তবর্তী পঞ্চগড় জেলার জনগোষ্ঠীর নৃতাত্তিক বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের সামগ্রিক রূপের সঙ্গে অভিন্ন হলেও কোন কোন ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র বিদ্যমান। এ জেলার জনপ্রবাহের মধ্যে রয়েছ- হিন্দু ও মুসলিম প্রধান জনধারা, রাজবংশী, কোচ, পলিয়া, সাঁওতাল, ওঁরাও, হাড়ি, ভূইমাল, কামার-কুমার, বেহারা, কাহার, সুনরী প্রভৃতি। এই বিচিত্র জনধারার মিশ্র রূপায়ণেই গড়ে উঠেছে পঞ্চগড় জেলার নৃ-তাত্ত্বিক ভিত্তি। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী মোটামুটি দীর্ঘমুন্ড, প্রশস্ত নাসা, আদি অষ্ট্রেলীয়-দীর্ঘমুন্ড ও দীর্ঘ মধ্যোন্নতনাসা, মিশর-এশিয়া বা "মেলানিড"; এবং বিশেষভাবে গোলমুন্ড, উন্নতনাসা-"অ্যালপাইন-এই তিন নরগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। পঞ্চগড় জেলার জলধারাও "আদি-অষ্ট্রেলীয়", "অ্যালপাইন" ও "মঙ্গোলীয়" নরগোষ্ঠীর মিশ্র বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে। নৃতত্ত্ববিদগণ প্রায় সকলেই একমত যে, নিম্নবর্ণের বাঙ্গালী আদিবাসী উপজাতিদের মধ্যে "আদি-অষ্ট্রেলীয়" জনধারার প্রভাব সবচেয়ে বেশী। বস্তুত, আর্য ও দ্রাবিড় মানবগোষ্ঠী পশ্চিম দিক থেকে আগমন করলেও "আদি-অষ্ট্রেলীয়" জনগোষ্ঠী অষ্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে এসে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছিল মধ্য ও উত্তর ভারতে। এমনকি, এরা বসতি গড়ে তোলে দক্ষিণ ভারত ও সিংহল পর্যন্ত। সিংহলের "ভেদ্দা প্রতীম" আদিবাসী পূর্বসূরি বাঙ্গালীদের এরা সমজাতীয় বলে অনেকের ধারণা।
বলাবাহুল্য, পঞ্চগড় জেলার মানবধারার একটি বৃহৎ অংশ "আদি-অষ্ট্রেলীয়" জনধারার অন্তর্গত। এদের নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- দীর্ঘ শির, প্রশস্ত নাক, নাকের গোড়া অক্ষিকোটর থেকে খুব উঁচু নয়, কপাল কিছুটা ভেতরের দিকে চাপা, ভ্রুর হাড় কিঞ্চিত উঁচু। মুখের নিম্নভাগ সামান্য লম্বা ধরণের। ঠৌঁট যথেষ্ট মোটা, থুতনি কিছুটা কম উঁচু। মাথার চুল তরঙ্গায়িত ও কুণ্ডলাকৃত। চুলের রং গাঢ় বাদামি থেকে কাল, দাড়ি গোঁফ মোটামুটি হয় কিন্তু দেহে লোমের পরিমাণ কম। গায়ের রং বাদামি থেকে ঘোরতর কালো। দেহাকৃতি খাটো ও মাঝারি ধরনের। (৫ ফুট ২ ইঞ্চি)
পঞ্চগড় জেলার আদিবাসী-উপজাতি প্রতিম অর্থাৎ সাঁওতাল, ওঁরাও, হাড়ি, ভূঁইমালি, কামার, কুমার, বেহারা, কাহার, সুনরী প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর মানুষ মূলত "আদি-অষ্ট্রলীয়" নরগোষ্ঠীর অন্তর্গত। তবে এ জেলার নিম্নবর্ণের হিন্দু-মুসলমানের রক্তে এই জনধারার প্রভাব সবচেয়ে বেশী। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে উচ্চবংশীয় জনসাধারণের মধ্যেও এই নরগোষ্ঠীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। পামীর মালভূমি, তাকলামাকান মরুভূমি, আল।পস পর্বত (তুর্কী বাইরানীয়) দক্ষিণ আরব ও ইউরোপের পূর্বাঞ্চলবাসী গোলমুন্ড বিশিষ্ট একটি প্রবাহ বাংলাদেশের জনধারায় নিজেদের রক্ত প্রবাহ সঞ্চারিত করে। এই জনের সর্ব প্রাচীন সাক্ষ্য সংগৃহীত হয়েছে "হরপ্পা" ও "মোহেন-জো-দারো"-তে প্রাপ্ত কঙ্কাল থেকে। এই জনধারাকে নৃতত্ত্ববিদ লাপোং, রিজলী, লুসসান ও রামপ্রসাদ চন্দ "অ্যালপাইন" নরগোষ্ঠীরূপে আখ্যায়িত করেন। বাংলাদেশের উচ্চবর্ণের ও মধ্যম নাসাকৃতি এবং মধ্যম দেহ-দৈর্ঘ্যের লক্ষণ দেখা যায়- তা অনেকাংশে "অ্যালপাইন" নরগোষ্ঠীর দান। এই জনগোষ্ঠীর রক্তধারা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো পঞ্চগড় জেলার সম্ভ্রান্ত বংশীয় মুসলিম এবং হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মধ্যেও বিরাজমান। বস্তুত, বাংলাদেশের যে, নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও সংস্কৃতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছে, তার প্রায় সমগ্র মূল রূপায়ণই প্রধানতঃ "অ্যালপাইন" ও "আদি-অষ্ট্রেলীয়" এই দুই জনধারার লোকদেরই কীর্তি। পঞ্চগড় জেলা সম্পর্কে এই মন্তব্য প্রণীধানযোগ্য।
'বোডো' ভাষাগোষ্ঠী বা মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কোচ, রাজবংশী, পলিয়া ইত্যাদি জাতির একটি প্রধান ধারা পঞ্চগড় জেলায় পরিলক্ষিত হয়। এদের নৃবৈশিষ্ট্য হচ্ছে- নাক মধ্যমাকৃতি থেকে চ্যাপ্টা, মাথার আকৃতি সাধারণত গোল, অক্ষিপট সন্মুখীন, উন্নত গন্ডাস্থি, কেশবিহীন দেহ ও মুখমন্ডল, সোজা চুল, দাড়ি গোঁফ বিরল, গায়ের রং পীতাভ অথবা বাদামি পীতাভ এই জনগোষ্ঠী অতি প্রাচীনকালে দক্ষিণ-পশ্চিম চীন হতে ক্রমশ বৃহ্মদেশ, মালয় উপদ্বীপ এবং পূর্ব-দক্ষিণ সমুদ্র উপকূলীয় দেশ ও দ্বীপগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। পথে উত্তর আসাম এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় মিরি, নাগা, বোদো বা মেচ সম্প্রদায়ভূক্ত কোচ, পলিয়া, রাজবংশী প্রভৃতি লোকের মধ্যে একটি ধারা প্রবাহ ঐতিহাসিককালে বাংলাদেশে এসে ঢুকে পড়ে এবং রংপুর, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি প্রভৃতি অঞ্চলে এভাবেই খানিকটা মঙ্গোলীয় প্রভাব নিম্নস্তরের মানুষের রক্তে আত্মপ্রকাশ করেছে। পঞ্চগড় জেলার কোচ, পলিয়া, রাজবংশী জনগোষ্ঠী উল্লেখিত জনপ্রবাহের উত্তরষূরী। এছাড়াও পঞ্চগড় জেলায় আরো কিছু সংখ্যক ছোট ছোট সম্প্রদায় দীর্ঘকাল যাবৎ বসবাস করে আসছে। জলপাইগুড়ি জেলার- যার অন্যতম প্রধান ৪টি থানাই ছিল ১৯৪৭সাল পর্যন্ত পঞ্চগড় জেলার অবিভক্ত অংশ- ১৮৭২ সালে ডঃ উইলিয়াম হান্টার এর জাতিগত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ওঁরাও-৪৫৩ জন, বাগদী-১৪৬ জন, বেদিয়া- ১০৮ জন, চামার- ৪৩৬ জন, চন্ডাল- ১৯৮০ জন, ডোম-১৭৩, দোসাদ-৫৪ জন, হাড়ি-৪৫৫৫জন, কোচ-০৪জন, রাজবংশী-১,৩৭,১৩৫জন, মেথর-৩১১ জন, ভূঁইমালি-১৭৮, ব্রাহ্মণ-১২৭৫ জন, রাজপুত-৫২৩ জন, বৈদ্য-৮২ জন, কায়স্থ-৫৪৭ জন, আগরওয়ালা-৪৪ জন, গন্ধবণিক-৩৯৯ জন, সুবর্ণবণিক-৮১ জন, গোয়ালা- ৯৫০ জন, বারুই-৪০৬ জন, কৈবর্ত-২৯৭০ জন, সদগোপ-২৭৬ জন, বেহারা-১৪৭৮ জন, ধোবী-১৬৬ জন, হাজাম, নাপিত-২৫০৫ জন, কাহার-১৭৮ জন, কামার-৫১১ জন, কাঁসারী-৪১ জন, কুমার-৩২১৫ জন, স্বর্ণকার (সোনার)-৫৬ জন, সুনরী-১১১৬ জন, সূত্রধর-৭৩ জন, তেলি-২৭২৮ জন, যুগী-৮১৩ জন, তাঁতি-৪০৩৪ জন, জালিয়া-১৩৭০ জন, মাঝি-২২৭ জন, পাটনী-৩৫ জন, বয়াতি-২০ জন, বৈঞ্চব-১৮৭৭ জন, সন্ন্যাসী-১৮৯ জন, দেশীয় খ্রিস্টান-০৪ জন, জোলা-১৭, পাঠান-৫৬ জন, শেখ-০৪ জন।
বলাবাহুল্য, পঞ্চগড় জেলার মানবধারার একটি বৃহৎ অংশ "আদি-অষ্ট্রেলীয়" জনধারার অন্তর্গত। এদের নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- দীর্ঘ শির, প্রশস্ত নাক, নাকের গোড়া অক্ষিকোটর থেকে খুব উঁচু নয়, কপাল কিছুটা ভেতরের দিকে চাপা, ভ্রুর হাড় কিঞ্চিত উঁচু। মুখের নিম্নভাগ সামান্য লম্বা ধরণের। ঠৌঁট যথেষ্ট মোটা, থুতনি কিছুটা কম উঁচু। মাথার চুল তরঙ্গায়িত ও কুণ্ডলাকৃত। চুলের রং গাঢ় বাদামি থেকে কাল, দাড়ি গোঁফ মোটামুটি হয় কিন্তু দেহে লোমের পরিমাণ কম। গায়ের রং বাদামি থেকে ঘোরতর কালো। দেহাকৃতি খাটো ও মাঝারি ধরনের। (৫ ফুট ২ ইঞ্চি)
পঞ্চগড় জেলার আদিবাসী-উপজাতি প্রতিম অর্থাৎ সাঁওতাল, ওঁরাও, হাড়ি, ভূঁইমালি, কামার, কুমার, বেহারা, কাহার, সুনরী প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর মানুষ মূলত "আদি-অষ্ট্রলীয়" নরগোষ্ঠীর অন্তর্গত। তবে এ জেলার নিম্নবর্ণের হিন্দু-মুসলমানের রক্তে এই জনধারার প্রভাব সবচেয়ে বেশী। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে উচ্চবংশীয় জনসাধারণের মধ্যেও এই নরগোষ্ঠীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। পামীর মালভূমি, তাকলামাকান মরুভূমি, আল।পস পর্বত (তুর্কী বাইরানীয়) দক্ষিণ আরব ও ইউরোপের পূর্বাঞ্চলবাসী গোলমুন্ড বিশিষ্ট একটি প্রবাহ বাংলাদেশের জনধারায় নিজেদের রক্ত প্রবাহ সঞ্চারিত করে। এই জনের সর্ব প্রাচীন সাক্ষ্য সংগৃহীত হয়েছে "হরপ্পা" ও "মোহেন-জো-দারো"-তে প্রাপ্ত কঙ্কাল থেকে। এই জনধারাকে নৃতত্ত্ববিদ লাপোং, রিজলী, লুসসান ও রামপ্রসাদ চন্দ "অ্যালপাইন" নরগোষ্ঠীরূপে আখ্যায়িত করেন। বাংলাদেশের উচ্চবর্ণের ও মধ্যম নাসাকৃতি এবং মধ্যম দেহ-দৈর্ঘ্যের লক্ষণ দেখা যায়- তা অনেকাংশে "অ্যালপাইন" নরগোষ্ঠীর দান। এই জনগোষ্ঠীর রক্তধারা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো পঞ্চগড় জেলার সম্ভ্রান্ত বংশীয় মুসলিম এবং হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মধ্যেও বিরাজমান। বস্তুত, বাংলাদেশের যে, নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও সংস্কৃতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছে, তার প্রায় সমগ্র মূল রূপায়ণই প্রধানতঃ "অ্যালপাইন" ও "আদি-অষ্ট্রেলীয়" এই দুই জনধারার লোকদেরই কীর্তি। পঞ্চগড় জেলা সম্পর্কে এই মন্তব্য প্রণীধানযোগ্য।
'বোডো' ভাষাগোষ্ঠী বা মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কোচ, রাজবংশী, পলিয়া ইত্যাদি জাতির একটি প্রধান ধারা পঞ্চগড় জেলায় পরিলক্ষিত হয়। এদের নৃবৈশিষ্ট্য হচ্ছে- নাক মধ্যমাকৃতি থেকে চ্যাপ্টা, মাথার আকৃতি সাধারণত গোল, অক্ষিপট সন্মুখীন, উন্নত গন্ডাস্থি, কেশবিহীন দেহ ও মুখমন্ডল, সোজা চুল, দাড়ি গোঁফ বিরল, গায়ের রং পীতাভ অথবা বাদামি পীতাভ এই জনগোষ্ঠী অতি প্রাচীনকালে দক্ষিণ-পশ্চিম চীন হতে ক্রমশ বৃহ্মদেশ, মালয় উপদ্বীপ এবং পূর্ব-দক্ষিণ সমুদ্র উপকূলীয় দেশ ও দ্বীপগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। পথে উত্তর আসাম এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় মিরি, নাগা, বোদো বা মেচ সম্প্রদায়ভূক্ত কোচ, পলিয়া, রাজবংশী প্রভৃতি লোকের মধ্যে একটি ধারা প্রবাহ ঐতিহাসিককালে বাংলাদেশে এসে ঢুকে পড়ে এবং রংপুর, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি প্রভৃতি অঞ্চলে এভাবেই খানিকটা মঙ্গোলীয় প্রভাব নিম্নস্তরের মানুষের রক্তে আত্মপ্রকাশ করেছে। পঞ্চগড় জেলার কোচ, পলিয়া, রাজবংশী জনগোষ্ঠী উল্লেখিত জনপ্রবাহের উত্তরষূরী। এছাড়াও পঞ্চগড় জেলায় আরো কিছু সংখ্যক ছোট ছোট সম্প্রদায় দীর্ঘকাল যাবৎ বসবাস করে আসছে। জলপাইগুড়ি জেলার- যার অন্যতম প্রধান ৪টি থানাই ছিল ১৯৪৭সাল পর্যন্ত পঞ্চগড় জেলার অবিভক্ত অংশ- ১৮৭২ সালে ডঃ উইলিয়াম হান্টার এর জাতিগত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ওঁরাও-৪৫৩ জন, বাগদী-১৪৬ জন, বেদিয়া- ১০৮ জন, চামার- ৪৩৬ জন, চন্ডাল- ১৯৮০ জন, ডোম-১৭৩, দোসাদ-৫৪ জন, হাড়ি-৪৫৫৫জন, কোচ-০৪জন, রাজবংশী-১,৩৭,১৩৫জন, মেথর-৩১১ জন, ভূঁইমালি-১৭৮, ব্রাহ্মণ-১২৭৫ জন, রাজপুত-৫২৩ জন, বৈদ্য-৮২ জন, কায়স্থ-৫৪৭ জন, আগরওয়ালা-৪৪ জন, গন্ধবণিক-৩৯৯ জন, সুবর্ণবণিক-৮১ জন, গোয়ালা- ৯৫০ জন, বারুই-৪০৬ জন, কৈবর্ত-২৯৭০ জন, সদগোপ-২৭৬ জন, বেহারা-১৪৭৮ জন, ধোবী-১৬৬ জন, হাজাম, নাপিত-২৫০৫ জন, কাহার-১৭৮ জন, কামার-৫১১ জন, কাঁসারী-৪১ জন, কুমার-৩২১৫ জন, স্বর্ণকার (সোনার)-৫৬ জন, সুনরী-১১১৬ জন, সূত্রধর-৭৩ জন, তেলি-২৭২৮ জন, যুগী-৮১৩ জন, তাঁতি-৪০৩৪ জন, জালিয়া-১৩৭০ জন, মাঝি-২২৭ জন, পাটনী-৩৫ জন, বয়াতি-২০ জন, বৈঞ্চব-১৮৭৭ জন, সন্ন্যাসী-১৮৯ জন, দেশীয় খ্রিস্টান-০৪ জন, জোলা-১৭, পাঠান-৫৬ জন, শেখ-০৪ জন।
১৯০১সালের জলপাইগুড়ি জেলা গেজেটিয়ারে উল্লেখিত ধর্মভিত্তিক ও উপজাতিভিত্তিক পরিসংখ্যান
থানা হিন্দু মুসলিম সর্বপ্রাণবাদ রাজবংশী ওঁরাও Nasya শেখ
রাজগঞ্জ ২৬,৯১৩ ২৪,৯৯২ ৭১ ২০,৩৬৫ ৩৯৭ ২১১০ ২২,৭৬২
তেঁতুলিয়া ৯০৭১ ১১৪৬৭ ------ ৫০৭০ ----- ৯৮৮১ ১৩৫৯
বোদা ৯১,৯২৪ ৭৩০৭৫ ------ ৭৬,৩৬৩ ২৫ ১১৮৭ ৭১,২১৩
১৯২১ সালে গৃহীত ধর্মভিত্তিক পরিসংখান
থানা হিন্দু মুসলিম সর্বপ্রাণবাদ খ্রিস্টান অন্যান্য
তেঁতুলিয়া ৭৯৪৫ ১১০৪৫ ১০ ০১ ০৩
বোদা ৪০১৪১ ৩৭২২২ ১১ ---- -------
পঞ্চগড় ১৪০৩৭ ১৮৭২৬ ১৩ ----- -------
দেবীগঞ্জ ৩৯৭৪২ ১৫২৯১ ৫০৪ ১০ ৯১
১৯২১ সালে গৃহীত আদিবাসী, উপজাতি পরিসংখ্যান
আদিবাসী/ উপজাতি তেঁতুলিয়া বোদা পঞ্চগড় দেবীগঞ্জ
রাজবংশী ৪৬৪৬ ৩১৪৫৯ ১১৯৩৮ ৩৪৩২৮
ওঁরাও ৩৯ ০৫ ০৯ ২৬৫
সাঁওতাল ০১ ৩০ ৫৭ ৫৯
মুন্ডা ০২ ০২ ০৭ ১০০
মেচ ------ ------ ------ ১৫
শেখ (মুসলিম) ১০৬৬৫ ৩৬৭০৭ ১৮৩৫৮ ১৪৯১০
১৯৩১ সালের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্ভূক্ত ৪টি থানার হিন্দু, উপজাতি ও আদিবাসীদের পরিসংখ্যান
হিন্দু/ আদিবাসী/ উপজাতি তেঁতুলিয়া বোদা পঞ্চগড় দেবীগঞ্জ
ব্রাহ্মণ ১৩৯ ২১১ ১১১ ১৫৪
কায়স্থ ৮৫ ৯৪১ ৪২ ৩৭৫
মুন্ডা ৫১ ----- ----- -----
ওঁরাও ১৬৯ ----- ---- ------
রাজবংশী ৬৯৮৫ ৩০০১৫ ১৩৩০৮ ৩৫২৬৯
সাঁওতাল ৬৭ ১৫২ ৫৮ ৫০৬
প্রায় ষাট বছর ব্যাপ্ত উল্লিখিত ধর্ম ও আদিবাসী-উপজাতি-গোত্রভিত্তিক পরিসংখান দ্বারা পঞ্চগড় জেলায় বসবাসরত বিভিন্ন নৃবৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সম্পর্কে একটি ধারণা অর্জন করা যায়। বস্তুত, উল্লিখিত জনপ্রবাহের সংমিশ্রণ ও সমন্বয়ের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে এ জেলার নৃতাত্ত্বিক ভিত্তি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। পঞ্চগড় জেলায় প্রাক-ঐতিহাসিক কাল থেকে এ পর্যন্ত সংমিশ্রণের ধারাটি মোটামুটি এ রকম-(ক) পাহাড়ী জাতি বা 'কিরাত' জনদের বসবাস। (খ) "আদি-অষ্ট্রেলীয়" নৃ-গোষ্ঠীর বসতি স্থাপন। (গ) "মঙ্গোলীয়" তথা "বোডো" গোষ্ঠীর জনদের আগমন। (ঘ) "অ্যালপাইন" নরগোষ্ঠী (পাল, সেন, তুর্কী, মোগল প্রভৃতি হিন্দু ও মুসলিম শাসক, সৈন্য, ধর্মপ্রচারক ও কর্মচারীর) আগমন ও বসতিস্থাপন। (ঙ) সিপাহী বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের পরাজিত বহিরাগত বিপ্লবীদের পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ, পঞ্চগড় ও তেঁতুলিয়া থানার গহীন অরণ্যে আত্মগোপন ও স্থায়ী বসবাস। (চ) ১৯৪৭ সালে ভারতের জলপাইগুড়ি থেকে এবং ১৯৫৩-৬৫ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের নোয়াখালি, ঢাকা, পাবনা ও ময়মনসিংহ জেলা থেকে লক্ষাধিক লোকের এ জেলায় আগমন ও বসতিস্থাপন।
পঞ্চগড় জেলার প্রাচীনতম জনগোষ্ঠী কারা, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য আমাদের হাতে নাই; পাওয়া সম্ভব নয়। তবে স্থানীয় অধিবাসীদের শারীরিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করে এ ধারণা সহজেই গ্রহণ করা চলে যে, তাদের পূর্ব-পুরুষগণের অনেকেই ছিলেন আদি-অষ্ট্রেলীয় নরগোষ্ঠীর অন্তর্গত। এই জনগোষ্ঠীর প্রভাব সম্প্রসারিত হয়েছে প্রধানত পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চল থেকে। তারও পূর্বে সম্ভবত "পাহাড়ী" ও "কিরাত" জাতি এ অঞ্চলে বসবাস করত বলে কালিকাপুরাণে উল্লেখ রয়েছে। এই দুই ধারণার পেছনে ঐতিহাসিক সত্য বিদ্যমান। বস্তুত, দক্ষিণ এশিয়া থেকে উত্তর ভারতের কাশ্মীর উপত্যকা পর্যন্ত বিন্তীর্ণ ভূ-ভাগ আদিম যুগ থেকে আদি-ঐতিহাসিক কালের প্রাচীন মানব জাতির অব্যাহত ক্রীড়াভূমি ছিল। পঞ্চগড় জনপদটি এই ভৌগলিক পরিসীমার মধ্যে অবস্থিত। হিমালয় পর্বত সানুদেশে এবং সন্নিহিত এলাকায় "কিরাত" জাতি (অনার্য) বসবাস করত, এদের সমশ্রেণীর আদিম মানুষদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো- কাহার, বেহারা, সুনরী, ভূঁইমালি, তাঁতি, দোসাদ, চন্ডাল, হাড়ি, ডোম, মেথর ইত্যাদি। পেশাজীবী হিসেবে এবং মর্যাদার পরিপ্রেক্ষিতে এরা বর্তমানকালে অতি নিম্নশ্রেণী হলেও আদিম অবস্থায় এদের সামাজিক মর্যাদা এতোটা খারাপ ছিল না। ডোম ,চন্ডাল, তাঁতি ইত্যাদি নিম্নবর্ণের মানুষের উল্লেখ রয়েছে চর্যাপদেও । অর্থাৎ অতি প্রাচীনকালে এইসব পেশাজীবী মানুষ বিশেষত উত্তরবঙ্গে বসবাস করত। পঞ্চগড় জনপদে এদের সঙ্গে আদি-ঐতিহাসিক কালে পূর্ব ও দক্ষিণ প্রান্ত থেকে আগত আদি -অষ্ট্রেলীয় মানুষদের সংমিশ্রণ ঘটেছে এবং গড়ে উঠেছে "আদি-অষ্ট্রেলীয়" নৃ-বৈশিষ্ট্য।
পৌরণিকযুগের "নরক রাজা" "কিরাত" জাতিকে বিতাড়িত কের "কামরূপ"-এ আর্যজাতির উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, পঞ্চগড় জেলা ছিল পশ্চিম কামরূপ - এর অভিন্ন অংশ। "বেদ"- এর ব্রাহ্মণভাগে দেখা যায় যে, আর্যগণ কৌশল এবং মিথিলার মধ্যবর্তী "সদানীরা নদী" অতিক্রম করে পূর্বদেশে (কামরূপে) উপস্থিত হয়েছিলেন। "শতপথ ব্রাহ্মণেও" তার উল্লেখ রয়েছে। সারণাচার্যের মতে, (পঞ্চগড় জেলায় প্রবাহিত) "করতোয়া" এবং "সদানীরা" অভিন্ন নদী। অমন সিংহ এবং হেমচন্দ্রের মতে, করতোয়ার নামই "সদানীরা"। পৌরণিককাল থেকে 'কামরূপ ' ক্ষেত্রে (পঞ্চগড় সহ) 'করতোয়া' একটি পবিত্র নদী বলে গণ্য হয়ে আসছে। কথিক আছে, হিমালয় কর্তৃক কন্যা সম্প্রদানকালে মহাদেবের হস্তচ্যুত জল থেকে করতোয়া উদ্ভুত হয়েছিল। সূতরাং প্রায় নিশ্চিত যে, আর্যরা পঞ্চগড় জেলার উপর দিয়েই আরো পূর্বে কামরূপ -কামাখ্যা পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। তারা মিথিলা হয়ে কামরূপে আসেন। বঙ্কিমচন্দ্রের মতেও- কামরূপ একটি প্রাচীন আর্যভূমি। পুরাণাদিতে এই দেশ "অতি পবিত্র" বলে উল্লেখিত আছে। "পান্ডবেরা" মহাপ্রস্থানকালে "লোহিত্যসাগরের" (ব্রহ্মপুত্র) তীর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। অর্জন তার গান্ডীব বিসর্জন দিয়েছিলেন বৃহ্মপুত্র নদের জলে। পৌরণিককালে শ্রীকৃষ্ণ, ভীম, কর্ণ এবং অর্জুনের দিগ্বিজয়ের প্রয়োজনে কামরূপে আগমনের উল্লেখ আছে। এভাবেই কামরূপে তথা পঞ্চগড়ের জনপদেও আর্য সমাগম ঘটে এবং কিছু পরিমাণে হলেও আদি-অষ্ট্রেলীয় রক্তধারার পাশাপাশি "অ্যালপাইন" নৃজাতিক বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়।
বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক "হিউ এন সাং" ৭ম শতকের মধ্যভাগে পঞ্চগড় জেলার প্রান্তদেশীয় কোনো অঞ্চল দিয়ে "কামরূপে" আগমন করেন। ৭ম শতাব্দীতে তিব্বতীয়গণ বঙ্গ ও মগ্ধ আক্রমণ করেন। কামরূপের রাজা ভাস্কর বর্মা তিব্বতীয়দের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। তিব্বতীয়রা অবশ্যম্ভাবীরূপেই পঞ্চগড় জেলার জনপদ দিয়ে অতিক্রম করেছিলেন। ৮১৫-৮৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পাল রাজা দেবপালের রাজত্বকালে এবং কামরূপের রাজা বীরবাহুর সময় হিমালয় পর্বতের উপত্যকাবাসী "কম্বোজ" জাতি "গৌড়" রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। অন্যদিকে, খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে জনৈক শিবোশাসক কম্বোজ বংশীয় রাজা "গৌড়" রাজ্য অধিকার করেন। বর্তমান রংপুর ও পঞ্চগড় জেলার কোচ এবং মেচ প্রভৃতি জাতির লোককে এই কম্বোজ জাতির বংশধর বলে অনুমান করা হয়। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে- পালবংশীয় রাজাগণ কম্বোজ জাতীয় লোকদের ঘন ঘন আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পঞ্চগড় থেকে ১০ মাইল উত্তর-পূর্বাকোণে অবস্থিত বিখ্যাত ভিতরগড় দুর্গটি নির্মাণ করেন।
উল্লেখিত সূত্রগুলো থেকে এ সত্যই উদ্ঘাটিত হয় যে, অতি প্রাচীনকাল থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত পঞ্চগড় জেলায় হিমালয় সন্নিহিত পাহাড়ী অঞ্চল, চীন, তিব্বত, ভূটান প্রভৃতি উত্তরশায়ী দেশ ও জনপদ থেকে জনধারার ক্রমাগত আগমন ঘটেছে এবং গড়ে উঠেছ স্থায়ী বসতি। এদের প্রভাবে "মঙ্গোলীয়" বৈশিষ্ট্য স্বল্পমাত্রায় হলেও এ জেলায় সংমিশ্রিত হয়েছে। পঞ্চগড় জেলার নৃতাত্ত্বিক পর্যালোচনার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে- মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত এবং 'বোডো' ভাষা ব্যবহারকারী কোচ, পলিয়া ও রাজবংশী জনদের ব্যাপক সংখ্যক এ জেলায় বসবাস। নৃতাত্ত্বিক বিচারে এরা একই জাতিভূক্ত কিনা, এ ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন মানববিজ্ঞানী ডঃ উইলিয়াম হান্টার, এইচ বিভারলে, এইচ এইচ রিজলী এবং ই. পোর্টার প্রমুখ। নৃবিজ্ঞানী রমাপ্রসাদ চন্দের মতে- তিব্বতীয় বা মঙ্গোলীয় আকারের কোচ, পলিয়া ও রাজবংশী প্রভৃতি জাতি তিব্বতীয় বা ভূটিয়া আক্রমণকারীগণের অনুচরদের বংশধর বলেই মনে হয়। কোচ ও তিব্বতীয় দুই ভিন্ন জাতি হিসেবে উল্লেখ করেন রংপুর ধর্মসভার সভাপতি যাদবেশ্বর তর্করত্ন। মানববিজ্ঞানী হ্যামিল্টন ও স্যার রিজলী উল্লেখ করেন যে, কোচ, পলিয়া ও রাজবংশী মূলত একই গোষ্ঠীভূক্ত তিনটি শাখা।
কিন্তু রাজবংশী বর্তমানে নিজেদের কোচ জাতির অন্তর্ভূক্ত বলে পরিচয় দিতে অস্বীকার করেন। জলপাইগুড়ি জেলা গেজেটিয়ারের ১৮৭২,১৯০১,১৯১১ ও ১৯৩১ সালের পরিসংখ্যানগুলোতে 'রাজবংশী'দের প্রধান সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু কোচ ও পলিয়া জাতির কোনো তথ্য উল্লেখিত পরিসংখ্যাণে না দেওয়ার কারণ হচ্ছে- এরা নিজেদের ঐ পরিচয় আর স্বীকার করছেন না। বরং অনেকেই ক্ষত্রিয় বা হিন্দু বলেই দাবী করেন। ১৯৬১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায় যে, বোদা, আটোয়ারী, দেবীগঞ্জ ও পঞ্চগড় থানায় কোচ, পলিয়া ও রাজবংশীর সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার শতকরা চল্লিশভাগ আর হিন্দুদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত নগণ্য। স্মরণ করা যেতে পারে যে, পঞ্চগড় জেলা ছিল দীর্ঘদিন কামরূপ ও কোচবিহার রাজ্য এবং জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত- যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী ছিলেন কোচ, পলিয়া ও রাজবংশীগণ। সূতরাং এ সত্য স্বীকার না করে উপায় নেই যে, এ জেলার অমুসলিম অধিবাসীদের অধিকাংশই "রাজবংশী" এবং রাজবংশীয় আবরণে কোচ ও পলিয়াও বটে। দৃষ্টান্ত হিসেবে তাকানো যায় "বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট" গেজেটিয়ারের ১৯৩১ সালের পরিসংখ্যানের প্রতি- যেখানে প্রদর্শিত হয়েছে নিম্নরূপ তথ্যঃ
জাতি তেঁতুলিয়া বোদা পঞ্চগড় দেবীগঞ্জ
ব্রাহ্মণ ১৩৯ ২১১ ১১১ ১৫৪
কায়স্থ ৮৫ ৯৪১ ৪২ ৩৭৫
রাজবংশী ৬৯৮৫ ৩০০১৫ ১৩৩০৮ ৩৫২৬৯
কায়স্থ ৮৫ ৯৪১ ৪২ ৩৭৫
রাজবংশী ৬৯৮৫ ৩০০১৫ ১৩৩০৮ ৩৫২৬৯
বিভিন্ন পরিসংখানে কোচ ও পলিয়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রদর্শিত হয়েছে। জেলা সৃষ্টির পূর্বে ঠাকুরগাঁও মহকুমায় (পঞ্চগড় সহ) পলিয়া জনসংখ্যা ছিল ৫০ হাজার। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশ কোচ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা- ১,৫৬,০০০। উভয় তথ্য থেকে এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়া চলে যে, কোচদের কোচবিহার এবং বর্তমান বৃহত্তর রংপুর জেলার পার্শ্ববর্তী জেলা হিসেবে পঞ্চগড়েও 'পলিয়া' ও 'কোচ' জাতি উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বসবাস করে। পঞ্চগড় জেলায় বর্তমানে(১৯৮৪) হিন্দু সংখ্যা দেখানো হয়েছে এক লক্ষের কিছু বেশী। বস্তুত, এদের অধিকাংশই যে কোচ, পলিয়া ও রাজবংশী জাতিভুক্ত, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, আজ তারা নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দিলেও হিন্দু ধর্মের বাঁধনটা তাদের অত্যন্ত শিথিল। বিধবা বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ প্রথা বহু প্রাচীনকাল থেকেই তাদের মধ্যে প্রচলিত। আহার-বিহার, চাল-চলন, পূজা-পার্বণ ইত্যাদি ব্যাপারে এরা হিন্দুদের থেকে স্বতন্ত্র। তারা হিন্দু দেবদেবীদের গ্রহণ করলেও তাদের মধ্যে ভিন্ন রীতিনীতি ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান। আজও "কালিপূজা" এদের সর্ববৃহৎ উৎসব। বিষ্ণু এদের কাছে তেমন কোনো বিশিষ্ট দেবতা নয়। হিন্দুদের সর্ববৃহৎ উৎসব 'দুর্গা' পূজার তেমন কোন প্রভাব এদের মধ্যে নেই।
কোচ ও রাজবংশীদের উৎপত্তির ইতিহাসটিও এ প্রসঙ্গে জেনে নেয়া যায়।- প্রাচীন কামরূপ রাজ্য অহোম ও কোচ জাতি দ্বারা অধিকৃত হয়। অহোমরা পূর্ব কামরূপ এবং কোচরা পশ্চিম কামরূপ (বর্তমান কোচবিহার, রংপুর ও পঞ্চগড়) দখল করে নেয়। পরিশেষে কোচেরা কেন্দ্রীভূত হয় কোচবিহার ও বৈকুন্ঠপুরে (জলপাইগুড়ি)। কোচদের প্রধান ও প্রথম নায়কের নাম "হাজো"। তিনি "খেন" জাতিদের পরাস্ত করে ১৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে কোচরাজবংশের সৃষ্টি করেন এবং প্রায় ৪৫০ বছর রাজত্ব করে তার উত্তরসূরীগণ। "হাজো" ছিলেন "বোডো" জাতির মানুষ।প্রাচীনকালে 'বোডা'রা 'পাটকই' পাহাড়ের মধ্য দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের কূল ধরে উত্তর-পূর্ব আসামে এসে পৌঁছেছিলেন। আসামের পশ্চিমভাগ এবং নেপালের 'তরাই' ভূমির পূর্বভাগ হাজোর অধীনে ছিল। বস্তুত উভয় অঞ্চল বর্তমানে পঞ্চগড় জনপদের সংলগ্ন। কোচ নায়ক হাজোর দৌহিত্র শিশু ও বিশু শিশ্বসিংহ নাম ধারণ করে যথাক্রমে বৈকুন্ঠপুর (জলপাইগুড়ি) ও কোচবিহারের রাজা হন। এভাবেই তারা একদিকে উপজাতির পর্যায় থেকে 'রাজবংশে' উন্নীত হন এবং হিন্দুধর্ম গ্রহণ করে 'কোচ' নাম ঘুচিয়ে ফেলেন। সেই থেকে 'রাজবংশী' নামে উৎপত্তি। রাজবংশীগণ 'ক্ষত্রিয়' বলেও নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকেন। বস্তুত, পঞ্চগড় জেলার লৌকিক ধর্মবিশ্বাস, প্রথা-উৎসব এবং সাংস্কৃতিক পরিচর্চায় কোচ, পলিয়া ও রাজবংশী- এই তিন জনগোষ্ঠীর অবদান সর্বাধিক। অনুমান করা হয় যে, এদের মধ্যে থেকেই ইসলাম ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়া সবচেয়ে বেশি সম্পন্ন হয়েছে।
নৃ-বিজ্ঞানী গৌতম শংকর রায় দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি (বর্তমান পঞ্চগড় জেলাসহ) এলাকার রাজবংশীদের নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করেছেন এভাবে- শিরাঙ্ক ৭৫.৮ সে.মি., নাসাংক-৭২.৪ সে.মি. এবং উচ্চতা-১৬০.৩ সে.মি.। পক্ষান্তরে নৃ-বিজ্ঞানী রিজলী বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর গড় নৃ-বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করেছেন এভাবে- মুসলিম শিরাঙ্ক-৭৮.০ সে.মি., নাসাংক-৭৭.৫ সে.মি. এবং উচ্চতা ১৬৩.৪ সে.মি.। পঞ্চগড়ের মুসলিম ও রাজবংশী তথা হিন্দু জাতির নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যও মোটামুটি উল্লেখিত সূচাকাঙ্কের অনুরূপ। 'অ্যালপাইন' নরগোষ্ঠীর আরেকটি ধারা মুসলিম অধিকারের পর পঞ্চগড়ের জনপদে আগমন করে তাদের রক্তধারার মিশ্রণ ঘটে স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে। এরা মূলত বহিরাগত মুসলিম শাসক, সৈন্য, কর্মচারী ও ধর্মপ্রচারক। পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী ও তেঁতুলিয়া থানার বেশ কিছু সংখ্যক মুসলিম পরিবারের মধ্যে এবং বিচ্ছিন্নভাবে অন্যান্য থানার কিছূ কিছু পরিবারের মধ্যেও এই জনগোষ্ঠীর "জন"দের দেখা যায়। এদের গৌর বর্ণ, উন্নত নাক, প্রশস্ত ললাট, ঋজু ও কোমল চুল এবং মাথার খুলির গঠন স্থানীয় অন্যান্য অধিবাসীদের চেয়ে পৃথক। বস্তুত বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার মতো পঞ্চগড় জেলার মুসলিম জাতি তিনটি উপাদানের সংকর- (১) বিদেশী বা আগন্তুক মুসলিম উপাদান, (২) মিশ্র উপাদান এবং (৩) ধর্মান্তরিত উপাদান।
উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সংঘটিত সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়ে গেলে বিপর্যন্ত বহু সিপাহী তেঁতুলিয়া সংলগ্ন ঘন জঙ্গলসহ নেপাল-ভূটান পর্যন্ত অঞ্চলে পলায়ন করেন এবং আত্মগোপন করে থাকেন। ফাঁসি দেওয়া, সিপাহীপাড়া প্রভৃতি গ্রাম সিপাহী বিপ্লবের স্মৃতিবহ। "ফাঁসি দেওয়া" নামক স্থানে সিপাহীদের ফাঁসি দেওয়া হয়। এই জনপদে ফকির মজনু শাহ, ভবানীপাঠক প্রভৃতি, ফকির ও সন্ন্যাসী নেতার নেতৃত্বে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন সংঘটিত হয়। সন্ন্যাসী কাটা, সন্ন্যাসী পাড়া, দেবীগঞ্জ, দেবীডোবা প্রভৃতি অঞ্চলের নামকরণ সেই স্মৃতিকে ধারণ করেই করা হয়েছে। 'সন্ন্যাসীকাটা'য় ধৃত সন্ন্যাসীদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ফকির ও সন্ন্যাসী বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী অনেক ফকির ও সন্ন্যাসীও এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। এছাড়াও ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর 'জলপাইগুড়ি' জেলা থেকে এবং ১৯৫৩ সাল থেকে পূর্ববঙ্গের নোয়াখালী, ঢাকা, পাবনা ও ময়মনসিংহের বিপুল সংখ্যক মানুষ পঞ্চগড় জেলায় এসে স্থায়ীভাবে থেকে যান।
উল্লেখিত জনপ্রবাহ ধীরে ধীরে স্থানীয় জনধারার সঙ্গে নিজেদের মধ্যে মিশিয়ে ফেলেন। বহিরাগত এই জন প্রবাহের মধ্যে অ্যালপাইন, মঙ্গোলীয়, দ্রাবিড়, আদি-অষ্ট্রেলীয় প্রভৃতি মিশ্র উপাদান।পঞ্চগড় জেলার নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বিনির্মাণে এদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত উত্তরবঙ্গে অধিকাংশ মানুষের নৃবৈশিষ্ট্যের প্রায় অনুরূপ "অষ্ট্রিক-মঙ্গোলীয়" এবং "অ্যালপাইন" নরগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে পঞ্চগড় জেলার অধিবাসীদের মিশ্র মানব বৈশিষ্ট্য। তথ্যসূত্রঃ -নাজমুল হক [ পঞ্চগড় জেলার ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি, বাংলা একাডেমী, ঢাকা]